স্বজনদের কাছে পুতুল। পোশাকি নাম খালেদা খানম। ক্যাপ্টেন (পরে লে. জেনারেল) জিয়াউর রহমানকে বিয়ে করে হন খালেদা জিয়া। হন সেনাপ্রধান ও পরে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী। নিয়তি তাঁকে টেনে আনে রাজনীতির পিচ্ছিল পথে। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর এক শূন্যতার মধ্যে তাঁর দল বিএনপির হাল ধরেন। আট বছর স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সামনের কাতারে ছিলেন। তাঁর হাতেই এলোমেলো হয়ে যাওয়া বিএনপির পুনর্জন্ম ঘটে। খালেদা জিয়ার উত্তরণ হয় গৃহবধূ থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবে।
আশির দশকে ক্ষমতাসীন এরশাদের অধীন নির্বাচনে যেতে অস্বীকার করেন তিনি। এ জন্য তিনি কয়েকবার গ্রেপ্তার ও গৃহবন্দী হন। কিন্তু একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে অটল থাকেন তিনি। জনমনে তিনি হয়ে ওঠেন ‘আপসহীন নেত্রী’। আন্দোলন ও ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে তাঁর যে সম্মোহনী শক্তি গড়ে ওঠে, তার ওপর ভর করে সব রকমের পূর্বাভাস মিথ্যা প্রমাণ করে ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে দলকে জিতিয়ে আনেন। তিনি হন দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। বলা চলে, একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জিতে আসা দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। এ অর্জন কখনো কেড়ে নেওয়া যাবে না।
তিন মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। দ্বিতীয় মেয়াদের আয়ু ছিল মাস দুয়েক। যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছিলেন, সেই ব্যবস্থাকে তিনি উপেক্ষা করে সংকটের জন্ম দেন। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে একতরফা নির্বাচন করে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার চেষ্টা ছিল অনভিপ্রেত। বিরোধীদের আন্দোলনের মুখে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা মেনে নেন এবং সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনেন। এ ব্যবস্থায় পরপর দুটি নির্বাচন হয়।
ইতিহাস খালেদা জিয়াকে কীভাবে মনে রাখবে? বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে এক জনপ্রিয় জেনারেলের হাতে। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলটির পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন খালেদা জিয়া। সেই সঙ্গে তিনিও হতে পেরেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা।
মনে হচ্ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেবে। কিন্তু সেটি আবারও হোঁচট খায়। পছন্দের লোককে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বানাতে তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ান। ফলে আবারও তৈরি হয় রাজনৈতিক সংকট। এ পটভূমিতে সংঘটিত হয় সেনা অভ্যুত্থান, যা এক-এগারো নামে পরিচিতি পায়। রাজনীতি চলে যায় ব্যাকফুটে। খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হন। তাঁর সন্তানেরা হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন। তা সত্ত্বেও তিনি এক-এগারোর কুশীলবদের সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যাননি। এর মূল্য দিতে হয় তাঁকে।
সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে তাঁর দলের হাতে মাত্র ৩০টি আসন গছিয়ে দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ তার মিত্রদের নিয়ে সরকার গঠন করে।
এরপর খালেদা জিয়া ধারাবাহিকভাবে ঈর্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে থাকেন। এক-এগারোর সময়ের তুচ্ছ একটি মামলায় তাঁকে ফাঁসিয়ে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একসময় মনে হচ্ছিল, তিনি এ জীবনে বুঝি আর মুক্ত আলো-বাতাসে বিচরণ করতে পারবেন না। ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলন পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। শেখ হাসিনার পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে চলে যান। ৬ আগস্ট মুক্ত হন খালেদা জিয়া। তিনি ঐক্যের ডাক দেন। ৭ আগস্ট ঢাকায় বিএনপির এক সমাবেশে ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘শান্তি, প্রগতি, সাম্যের ভিত্তিতে আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে আসুন আমরা তরুণদের হাত শক্তিশালী করি। ধ্বংস নয়, প্রতিশোধ নয়, ভালোবাসা, শান্তি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলি।’ তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে নিয়ে তিনি একটিও নেতিবাচক মন্তব্য করেননি। তাঁর এ সৌজন্যবোধ, পরিমিতিবোধ ও উদারতা রাজনীতিতে একটি মানদণ্ড হয়ে থাকবে।
খালেদা জিয়া নানা অসুখে ভুগছিলেন। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই তাঁর শারীরিক জটিলতা বেড়ে যায়। রাজনীতিতে তিনি আর সক্রিয় হয়ে উঠতে পারেননি। ব্যাধির কাছে একসময় হার মানতেই হলো।
বিএনপিতে নানা স্রোতোধারা। আদর্শিক রাজনীতি কেতাবেই বাঁধা পড়ে আছে। দলে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব আছে। এত দিন খালেদা জিয়াই ছিলেন দলের ঐক্যের প্রতীক। তাঁর অবর্তমানে দলটির সংহতির বুনন দুর্বল হয়ে যেতে পারে কি না, সেটা দেখার বিষয়। এ চ্যালেঞ্জ বিএনপিকে মোকাবিলা করতে হবে।
ইতিহাস খালেদা জিয়াকে কীভাবে মনে রাখবে? বিএনপির জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকে এক জনপ্রিয় জেনারেলের হাতে। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দলটির পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন খালেদা জিয়া। সেই সঙ্গে তিনিও হতে পেরেছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। নিরপেক্ষ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে কোনো আসনে না হারার এক অনতিক্রম্য রেকর্ড গড়েছেন তিনি। রাজনীতিতে আসার এক দশক পূর্ণ হওয়ার আগেই তিনি রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী হয়েছেন। গণতান্ত্রিক অভিযাত্রায় এটিও একটি তুলনাহীন অর্জন।
এটা বলতে দ্বিধা নেই, এ মুহূর্তে খালেদা জিয়ার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতা দেশে আর নেই। আজ (৩০ ডিসেম্বর ২০২৫) তাঁর মৃত্যুর ফলে যে শূন্যতা তৈরি হলো, তা কীভাবে পূরণ হবে, সেটি দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। ইতিহাসে কেউই অপরিহার্য নন। আবার কেউ কেউ তাঁদের অর্জন ও ব্যক্তিত্ব দিয়ে জনমনে দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যান। খালেদা জিয়া ইতিহাসে অবশ্যই জায়গা করে নিয়েছেন।