বরিশাল সিটি নির্বাচনের পরও নগর বিএনপিতে বিতর্ক থামছে না

পদ-পদবি নিয়ে রেষারেষি আছে এমন নেতা-কর্মীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে চেষ্টা করছেন।

বরিশাল জেলার মানচিত্র

বরিশাল সিটি নির্বাচন বর্জন করেও বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না বিএনপির। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে নির্বাচন করায় বরিশালে ১৯ নেতা-কর্মীকে আজীবন বহিষ্কার করেছে দলটি। তবে পদে আছেন এমন অনেক নেতার বিরুদ্ধে পরোক্ষভাবে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচন করা, নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থীদের মিষ্টিমুখ করানোসহ নানা বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এ নিয়ে দলীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা কানাঘুষা থাকলেও মহানগের বর্তমান নেতারা নির্লিপ্ত। 

নির্বাচন করে বহিষ্কার হওয়া অন্তত তিনজন নেতা প্রথম আলোকে বলেন, দলের নেতৃত্বে থাকা অনেক নেতা পরোক্ষভাবে নির্বাচনে বিভিন্নজনের পক্ষে কাজ করেছেন। এমনকি তাঁদের আত্মীয়-স্বজনদের অনেকে আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টির প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। মূলত এসব কারণেই মহানগরের নেতারা নির্লিপ্ত। 

জয়ী হওয়ার পর নবনির্বাচিত কাউন্সিলর লোকজন নিয়ে আমার বাড়িতে আসেন। এমন একজন লোককে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতে পারি? দল করলেও আমরা তো একটা সমাজে বাস করি। এখন এটিকে ইস্যু বানানো দুঃখজনক।
কে এম শহিদুল্লাহ, যুগ্ম আহ্বায়ক, বরিশাল মহানগর বিএনপি

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের একজন বিজয়ী কাউন্সিলরকে মিষ্টিমুখ করানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে গত রোববার মহিলা দলের মহানগরের সভাপতি ফারহানা ইয়াসমিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় মহিলা দল। এ চিঠি নিয়ে দলে নানা প্রশ্ন উঠেছে। মহানগর বিএনপির বর্তমান ও সাবেক অন্তত চারজন নেতা বলেছেন, একজন কাউন্সিলরকে মিষ্টিমুখ করানোয় যদি ফারহানা ইয়াসমিনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়, তাহলে অন্য যেসব নেতার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে, তাঁরা কেন জবাবদিহির বাইরে থাকবেন?

বিএনপির নেতারা জানান, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া বহিষ্কৃত হওয়া কামরুল আহসান বিএনপির কেন্দ্রীয় এক নেতার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিলেন। ওই নেতার ভাই প্রকাশ্যে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষে সভা-সমাবেশ করেছেন। কিন্তু সেই অভিযোগের বিষয়ে দল নির্লিপ্ত। অভিযোগ তোলার পর কামরুলের বিরুদ্ধে ফেসবুকে নানা সমালোচনা হয়। এমনকি নির্বাচনের পর এর জেরে কামরুলের ছবিতে আগুন দেওয়া হয়। 

একই সঙ্গে মহানগর বিএনপির বর্তমান আহ্বায়কের ভাই নৌকার প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক এইচ এম তছলিম উদ্দীনের বড় ভাই জাতীয় পার্টির প্রার্থী ছিলেন। এ ছাড়া মহানগর বিএনপির ১ নম্বর সদস্য আ ন ম সাইফুল আহসানের স্ত্রী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সাইফুল স্ত্রীর পক্ষে মাঠেও ছিলেন। ৬ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির এক নেতা তাঁর জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীর নির্বাচনী কার্যালয় করার অনুমতি দিয়েছেন। এ ছাড়া জেলা যুবদলের সাংগঠনিক সম্পাদক হাফিজ উদ্দীন ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলকে মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন, নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কে এম শহিদুল্লাহ ১২ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন—এমন ছবিও সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে এসেছে। 

অভিযোগের বিষয়ে এইচ এম তছলিম উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টির প্রার্থী আমার ভাই। স্বাভাবিকভাবে যেহেতু একই বাড়িতে থাকি, এমন প্রশ্ন ওঠা সঙত। কিন্তু আমি তাঁর পক্ষে তৎপরতা চালিয়েছি বা কারও কাছে ভোট চেয়েছি এমন প্রমাণ কেউ দিতে পারবেন না।’ 

যুবদল নেতা হাফিজ উদ্দীন বলেন, ‘পদে থেকে যাঁরা নৌকা ও লাঙ্গলের নির্বাচন করেছেন, তাঁরাই আমার বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করেছেন। ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের সঙ্গে আমার যে ছবি ফেসবুকে ছাড়া হয়েছে, সেটা দুই বছর আগের। আমাকে ফাঁসাতে এসব করা হচ্ছে।’

কাউন্সিলরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর বিষয়ে মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কে এম শহিদুল্লাহ বলেন, ‘আমি ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ছিলাম। দলের সিদ্ধান্ত মেনে এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিনি। জয়ী হওয়ার পর নবনির্বাচিত কাউন্সিলর লোকজন নিয়ে আমার বাড়িতে আসেন। এমন একজন লোককে আমি বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলতে পারি? দল করলেও আমরা তো একটা সমাজে বাস করি। এখন এটিকে ইস্যু বানানো দুঃখজনক।’ 

সূত্র জানায়, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ সাঈদ আহম্মেদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ায় তাঁকে মিষ্টিমুখ করান মহিলা দলের মহানগরের সভাপতি ফারহানা ইয়াসমিন। এমন একটি ছবি সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এরপর গত রোববার ওই নেত্রীকে কেন্দ্রীয় মহিলা দলের পক্ষ থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। নোটিশে তাঁকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জবাব দিতে বলা হয়। 

নোটিশের বিষয়ে ফারহানা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৬ জুন বাসা থেকে বাজার করতে চৌমাথায় যাই। বাজার নিয়ে রিকশায় ভিড়ে আটকে গেলে এলাকার সাত থেকে আটজন নারী আমাকে রিকশা থেকে অনেকটা জোর করে নামিয়ে নবনির্বাচিত কাউন্সিলরের কাছে নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে দেখি সবাই মিষ্টিমুখ করাচ্ছেন।

কাউন্সিলরের স্ত্রী আমাকে বলেন, “আপা আপনি একটু মিষ্টিমুখ করান।” এই ছিল পুরো ঘটনা। এ ঘটনা ভিডিও করে দলের কাছে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়েছে।’ তিনি বলেন, দলের কিছু লোকের নোংরা রাজনীতির শিকার তিনি। শিক্ষক হওয়ার পরও তিনি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেননি। অথচ তাঁর বিরুদ্ধ ভয়ঙ্কর অভিযোগ দেওয়া হলো। 

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা জাহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেকের বিরুদ্ধেই এমন অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে অনুসন্ধান ও ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার কেন্দ্রের। ফারহানা ইয়াসমিনের বিষয়টি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের কাছে কে বা কারা পাঠিয়েছেন, তিনি জানেন না। তাঁর দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তাঁকে (ফারহানা) কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।