বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ড নেই: ফরহাদ মজহার

‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের সমালোচনা করে কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের মেরুদণ্ড নেই। যখন যার পক্ষে দাঁড়াবার দরকার, তার পক্ষে দাঁড়ানো কর্তব্য। এটা নীতির জায়গা। সবচেয়ে কঠিন সময়ে নীতির পক্ষের দাঁড়ানো কঠিন।’

সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের পক্ষে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন এবং সে সময় অন্য কেউ এ বিষয়ে কথা বলেনি উল্লেখ করে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘চিন্ময়ের পক্ষে দাঁড়ালাম, ভারতের দালাল হয়ে গেলাম। যখন হেফাজতের পক্ষে দাঁড়ালাম, জামাতি হয়ে গেলাম।’

আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিলে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। এই গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো।

ফরহাদ মজহার বলেন, চিন্ময় দাসকে ধরেছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। এই রাষ্ট্রদ্রোহিতা সেই ঔপনিবেশিক আইন। এ আইনের পক্ষে ওই ছেলেগুলো দাঁড়িয়েছে, যারা গণ–অভ্যুত্থান করেছিল, যাদের বিরুদ্ধে আগে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছিল। ওদের সে (আইনটির বিপক্ষে দাঁড়ানোর) সাহস হলো না।

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নাগরিক অধিকারের পক্ষে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘তাঁর (চিন্ময় দাস) বিচার হোক। তাঁকে জামিন দিলেন না। একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে গেল। এগুলো আমরা হতে দিয়েছি।’

গণ–অভ্যুত্থানের পরও কিছুই বদলায়নি উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘৮ আগস্টের পর শেখ হাসিনার সংবিধানের অধীনে চলে গেছে। এর মানে হচ্ছে যেসব প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করছেন, সেসব প্রতিষ্ঠান বহাল তবিয়তে আছে। আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ, বুদ্ধিজীবী, বিশ্ববিদ্যালয়—সবই আগের জায়গায় আছে, কিছুই পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এখনো ওই ভুল থেকে শিখছি না যে ৮ আগস্ট সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব হয়ে গেছে। যেহেতু ভাবছি না, তাই সমাধান দিতে পারছি না।’

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘অবশ্যই গণ–অভ্যুত্থান পথ, নির্বাচন না। নির্বাচন করার মানে হচ্ছে ওই পুরোনো লুটেরা মাফিয়া শ্রেণিকে আবারও আনবেন। ঠিক এনসিপিও সেটাই শিখছে। হ্যাঁ, নির্বাচনই করতে হবে। ওরাও ঠিকই চাঁদা চাইতেছে, বড় বড় হাউসের কাছে যাচ্ছে। দুই কোটি টাকা, পাঁচ কোটি টাকা।’

নির্বাচন চাওয়া এনসিপির কাজ না মন্তব্য করে ফরহাদ মজহার বলেন, তারা গণ–অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট (চেতনা) নিয়ে সামনে এসেছে, তাদের ওপর সমর্থন থাকবে। কিন্তু ক্রমাগতভাবে তাদেরকে অন্যায়ভাবে নিন্দা করা হচ্ছে। নির্বাচনের কথা বলে আরও খারাপের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বুদ্ধিজীবী, চিন্তাবিদদের ঐক্যের ওপর জোর দেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, ‘সমাজের যারা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যারা চিন্তা করতে পারে, তাদের মধ্যে একটা ঐক্য দরকার। কারণ, রাষ্ট্র মানেই হচ্ছে সমাজের বুদ্ধিবৃত্তিক স্তরের প্রতিফলন। রাষ্ট্রের যে দুর্দশা, তার জন্য আমরা যারা বসে আছি, তারা দায়ী।’ তিনি আরও বলেন, রাষ্ট্র ও সরকার এক নয়। শুধু সরকারের সমালোচনা করে এগোনো যাবে না।’

ফরহাদ মজহার বলেন, ‘বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যে লড়াই, তা অবশ্যই ইতিবাচক। বাঙালি জাতিবাদ নিয়ে সমস্যা আছে তার মানে এই নয় যে বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির জন্য এই যে জনগোষ্ঠীর লড়াই, এটা মিথ্যা। মিথ্যার দিকটা হচ্ছে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির জন্য যখন লড়াই করেছি, আমরা আমাদের সংস্কৃতি থেকে ইসলামকে বাদ দিয়েছি। ফলে আমরা ইসলামবিদ্বেষী এবং ইসলাম নির্মূলের রাজনীতি করেছি। এটা হচ্ছে সমস্যা। এই সমস্যা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সমাধান করতে হবে। নইলে এখানে ধর্মবাদের, জাতিবাদের উত্থানের পরিস্থিতি তৈরি হবে। এর জন্য আমরা দায়ী। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান হচ্ছে ওই ভুলগুলো শোধরাবার জায়গা।’

‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: এক বছরের অভিজ্ঞতা ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা করেন কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার। আজ বুধবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে
ছবি: প্রথম আলো

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের উদাহরণ টেনে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘বিভিন্ন জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জনগণ হাজির হয়ে গেছে। ঠিক তেমনি ৫ আগস্টের পরও জনগণ বর্তমান। এটা কোনো আইনের অধীনে নয়। আইনের অধীনে না হলে যদি সামরিক বাহিনী ঘোষণা দেয় সংবিধান স্থগিত রাখার এবং নিজের ফরমান দিয়ে দেশ চালায়। সংবিধান বাতিল করব এই অর্থে যেন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মানবিক, সাম্য, ইনসাফের যে অর্জন, সেটাকে আরও অর্জনের দিকে সামনে নিয়ে যাওয়া।’ তিনি আরও বলেন, এখনকার যুদ্ধ জাতিবাদের না। বাঙালি জাতিবাদের পরিবর্তে কেউ ধর্মীয় জাতিবাদ হাজির করলে সে–ও ফ্যাসিস্ট হয়ে যাবে। মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ।

ফরহাদ মজহার বলেন, অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস এখন জুলাই সনদ দেবেন। লুটেরা শ্রেণির রাজনীতিকদের সঙ্গে বসে সেটা দেবেন। কে তাঁকে এই অধিকার দিয়েছে? তিনি তো বিপ্লবের মহানায়ক নন। তিনি বিপ্লবের ফলমাত্র। তারই পরিণতি বাংলাদেশে এখন যা হচ্ছে তা। দ্রুত খারাপের দিকে এগোচ্ছে।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফের সঞ্চালনায় গোলটেবিল বৈঠকে আরও বক্তব্য দেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান, গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী সারা হোসেন, লেখক ও গবেষক আলতাফ পারভেজ, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস, নির্মাতা কামার আহমাদ সাইমন, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান, লেখক ও গবেষক মাহা মীর্জা, তরুণ গবেষক সহুল আহমদ প্রমুখ।