ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের শক্ত ভূমিকা চাই

  • নির্বাচন না হলে অস্থিতিশীলতার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা।

  • অনিশ্চয়তার অবসান এখন গুরুত্বপূর্ণ।

  • মঞ্চ প্রস্তুত করুন, দর্শকদের অধৈর্য করবেন না।

  • আইনশৃঙ্খলার কারণে নাগরিকেরা অস্থিরতায়।

‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনেরা। গতকাল ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: খালেদ সরকার

আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন করতে হবে। এ জন্য সরকারকে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন

না হলে দেশে অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ারও আশঙ্কা আছে।

গতকাল শনিবার প্রথম আলো আয়োজিত ‘নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক সমঝোতার পথ’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এ বক্তব্য উঠে এসেছে। কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত আলোচনায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

দেশে একটি ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উল্লেখ করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাষ্ট্রকাঠামোর ক্ষেত্রে কতগুলো পরিবর্তন নিশ্চিত করার জন্য আগামী নির্বাচন। রাষ্ট্রের কাঠামোগত পরিবর্তনগুলোর ব্যাপারে একমত হওয়া না গেলে নির্বাচনের মাধ্যমে দেশ যে জায়গায় যাবে, তাতে মৌলিক কোনো হেরফের ঘটবে না।

আগামী নির্বাচনের জন্য তিনটি পথ আছে বলে মনে করেন আলী রীয়াজ। প্রথমত, নির্বাচনের পূর্বশর্তগুলো রাজনৈতিক দলগুলোর পূরণ করা; দ্বিতীয়ত, সরকারের দৃঢ় অবস্থান নেওয়া; তৃতীয়ত, সংস্কার, নির্বাচন কিছু না করে বসে থাকা। একসময় ফেব্রুয়ারি আসবে, নির্বাচনও হবে। কিন্তু এরপর কী হবে, তা তিনি বলতে চান না। তাঁর আশঙ্কা,

ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন না হলে কেবল অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে তা নয়, জাতীয় নিরাপত্তাও বিঘ্নিত হবে।

সরকারের দৃঢ় পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে আলী রীয়াজ বলেন, দৃঢ় অবস্থানটা জরুরি। এ ছাড়া আর কোনোভাবে নির্বাচনে যাওয়া যাচ্ছে না। এর আগে সময় আছে, সবাই মিলে যদি একমত হয় ভালো। সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ওপরও গুরুত্ব দেন তিনি।

আলোচনার সূচনা করেন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান। সংস্কারপ্রক্রিয়ার শুরু থেকে এখন কোথায় সংস্কার আটকে আছে, তার একটি ধারণা তুলে ধরে তিনি বলেন, অতীত অভিজ্ঞতা হলো, চাপিয়ে দিয়ে সংস্কার হয় না। আবার পরিবর্তনের অঙ্গীকার করে ক্ষমতায় যাওয়ার পর তা বাস্তবায়ন করা হয় না। এবার একটি চমৎকার সুযোগ এসেছে। ৩০টি রাজনৈতিক দল দীর্ঘদিন ধরে আলোচনার মধ্য দিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের বিষয়ে ইতিমধ্যে একমত হয়েছে। শুধু বাস্তবায়ন প্রশ্নে গিয়ে আটকে গেলে দীর্ঘদিনের এই আলোচনা, তার আগের আন্দোলন-সংগ্রাম, অভ্যুত্থান, জীবন দেওয়া—সব বৃথা যাবে। দেশ আবারও অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে যেতে পারে।

সরকারকে শক্ত ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে মতিউর রহমান বলেন, ‘আমরা চাই, আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনে সব দল অংশ নেবে। আমরা আশা করি, সংস্কার নিয়ে আপনারা সবাই মিলে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারবেন। এই উদ্যোগে আমরা আপনাদের সঙ্গে থাকব।’

অনিশ্চয়তার অবসান না হলে সংকট বাড়বে

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, অনিশ্চয়তাই এখন সবচেয়ে বড় সংকট। এই অনিশ্চয়তা লাঘবে একটা তাগাদা থাকতে হবে। তিনি মনে করেন, সংস্কার প্রশ্নে আলোচনাটা একটি ‘এলিট নাগরিক বলয়ের’ মধ্যে হয়েছে, যে কারণে সমস্যা তৈরি হয়েছে। সংস্কারের অঙ্গীকারের বিষয়ে তিনি বলেন, রাজনীতিবিদদের ওপর জনগণের একধরনের অবিশ্বাস আছে যে তাঁরা অঙ্গীকারগুলো পরে রাখবেন না। এই দৃষ্টিভঙ্গিও সমস্যা তৈরি করছে।

কয়েকটি সংস্থার তথ্য উল্লেখ করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, দারিদ্র্যের মাত্রা আগে থেকেই বাড়ছে। সম্প্রতি বেকারত্ব বেড়ে যাওয়ার পরিসংখ্যানও দেখা গেল। শিক্ষায় ঝরে পড়াও বেড়েছে। তিনি মনে করেন, অনিশ্চয়তার কারণেই অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং জীবিকায় একধরনের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি হচ্ছে। অনিশ্চয়তার অবসান এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

হোসেন জিল্লুর বলেন, জুলাইয়ে যাঁরা আত্মাহুতি দিয়েছেন, অনিশ্চয়তা ও সংকীর্ণ স্বার্থে তাঁদের আত্মাহুতিকে অসম্মান করা যাবে না। গণতান্ত্রিক উত্তরণটা হওয়া দরকার। ঐকমত্য এবং অবিশ্বাস একত্রে চলতে পারে না। এত দিনের আলোচনায় অবিশ্বাসটা দূর হওয়া দরকার। এখানে সক্ষমতার প্রত্যাবর্তন দরকার। এ মুহূর্তে বাংলাদেশে ‘অনুপস্থিত সরকার সিনড্রোম’ আছে। তাই সক্ষমতার প্রত্যাবর্তন খুব দরকার।

আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিকল্প নেই বলে মনে করেন হা-মীম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও সিইও এ কে আজাদ। তিনি বলেন, নির্বাচন না হলে জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আসা প্রতিটি প্রস্তাবই গ্রহণযোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য। তবে সরকারের উচিত ছিল অনেক আগে এগুলো বাস্তবায়ন করা। যত সময় যাবে, এগুলোর বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যাবে।

এই ব্যবসায়ী নেতা মনে করেন, নির্বাচিত সরকারের মতো সক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের থাকে না, যা আইনশৃঙ্খলা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে। সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। নির্বাচন এখন অবধারিত, এটা ফেব্রুয়ারির মধ্যে হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। সংস্কার আগে না নির্বাচন আগে—এ প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলের কাছে সবকিছু ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। এটা সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জনগণ কেন ভুক্তভোগী হবে

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা ঐকমত্যে আসতে পারছে না, নিজেদের মধ্যে স্ববিরোধিতা আছে, ভিন্নতা আছে। তাদের মতভিন্নতার জন্য জনগণ কেন ভুক্তভোগী হবে?

মাহ্‌ফুজ আনাম বলেন, ‘এই সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তাদের দুটো দায়িত্ব ছিল। এক. সুশাসন; দুই সংস্কার। আপনি রিফর্ম যা-ই করেন, আপনি যদি সরকারের গদিতে বসেন, তাহলে প্রতিনিয়ত আপনাকে দেশ চালাতে হবে। বাজারে কী আসল না আসল, কোথায় কী হলো, এটার দায় আপনাকে নিতেই হবে।...আমি মনে করি, এই সরকার ব্যাপকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। আইনশৃঙ্খলার যে পরিবেশ, তাতে নাগরিকেরা একটা অস্থিরতার মধ্যে বাস করছে।’

হত্যা মামলা একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে ডেইলি স্টার সম্পাদক বলেন, এ মুহূর্তে বাংলাদেশে রাজনীতিক, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, সাবেক প্রধান বিচারপতি—সবাই হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। প্রধান বিচারপতি ভুল রায় দিলে সাজা হতে পারে। কিন্তু তিনি তো খুন করেননি, অথচ খুনের মামলার আসামি। আজকে এ মুহূর্তে প্রায় ২২৬ জন সাংবাদিক খুনের মামলার আসামি। দুর্নীতি বা সাংবাদিকতার অপব্যবহারের জন্য মামলা হতে পারে। কিন্তু খুনের মামলা দেওয়াটা হাস্যকর।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার বলেন, অনেকগুলো বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য হয়েছে। এখন এগুলো বাস্তবায়নের বিষয়। এখন বলটা বহুলাংশে রাজনৈতিক দলের কোর্টে। দলগুলোকে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে যে কীভাবে সংস্কার বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে এ ক্ষেত্রে সরকারকেও সুস্পষ্ট অবস্থান নিতে হবে।

২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কথা উল্লেখ করে বদিউল আলম বলেন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঠিক করতে হবে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে দেওয়া হয়। এগুলো করে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, যার পরিণতিতে শেখ হাসিনাকে পালাতে হয়েছে। এখন এ বিষয়গুলো যদি মেরামত না করা হয়, বিদ্যমান পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার মধ্যে যদি পরিবর্তন আনা না যায়, তাহলে আগে যা ঘটেছে, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।

মঞ্চ প্রস্তুত করুন

জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন প্রসঙ্গে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, মঞ্চ প্রস্তুত করুন, দর্শকদের অধৈর্য করবেন না। জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার প্রশ্নে হতাশাবাদীরা প্রাধান্য বিস্তার করে আছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনীতির নিয়ম হলো যতটুকু সম্ভব, ততটুকু করতে হবে। বাকিটার ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। এই বাস্তববাদিতা থাকা দরকার। সংবিধান নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে আরও অনেক গভীর সাংবিধানিক বিষয় সামনে আসতে পারে।

তবে সংস্কারের বিষয়টি ঠিকমতো নিষ্পত্তি না হলে চারটি অর্থনৈতিক বিষয়ে এর প্রতিঘাত আসবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সেগুলো হলো দ্রব্যমূল্য, শ্রমিক অসন্তোষের আশঙ্কা, কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ।

খুলনায় গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভিজ্ঞতা জানিয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, মানুষ নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা বলছে। আবার যে নির্বাচন হবে, সেটা গ্রহণযোগ্য হবে কি না এবং ভালো হবে কি না, সে প্রশ্নও মানুষের মধ্যে আছে। নির্বাচন ঠিকমতো না হলে রাজনৈতিক সংকট কাটবে না।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ছাড় দেওয়ার সংস্কৃতি না থাকার ফলে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের পরিস্থিতি আরও ‘হানাহানিমূলক’ হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সামিনা লুৎফা। তিনি মনে করেন, সে রকম পরিস্থিতি হলে নাগরিকই হবে এর প্রথম শিকার।

আইনশৃঙ্খলা, জননিরাপত্তার দিক থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের পারফরম্যান্স খুবই খারাপ উল্লেখ করে সামিনা লুৎফা বলেন, একটি জটিল সময়ে সুষ্ঠু ও হানাহানি মুক্তভাবে নির্বাচন করার জন্য সরকারের ওপর যে আস্থা-বিশ্বাস জনগণের থাকার কথা, এ মুহূর্তে তা নেই।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, যে সমঝোতা প্রয়োজন, সেটা কেবল জুলাই জাতীয় সনদকেন্দ্রিক নয়। সেটা আরও বড় ক্যানভাসের।

দলগুলোর নেতারা যা বললেন

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, তাঁরা ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে, রমজান শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে নির্বাচন চান। এ বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। আজ পর্যন্ত কেউ বলেনি এর পরে চায়। সংস্কারও সবাই চায়।

সালাহউদ্দিন বলেন, ‘এখন যদি নির্বাচনকে কন্ডিশনাল (শর্তসাপেক্ষ) করা হয়, সেটা কি আমাদের জন্য ঠিক হবে? সংস্কার এবং বিচার বাস্তবায়ন না হলে নির্বাচনে যাওয়া যাবে না, এ রকম অনেক বক্তব্য আসছে। নির্বাচন এবং সংস্কার বা বিচার—এগুলো তো মিউচুয়ালি ইন্টারডিপেন্ডেন্ট (পরস্পর নির্ভরশীল) নয়। বিচার সমাপ্ত হতে অনেক সময় লাগবে, এটা চলবে। বিচারের জন্য যদি আমরা কোনো টাইমলাইন নির্ধারণ করি, সেটা অবিচার হবে। বিচার নিশ্চিত করতে হবে, এর সঙ্গে আমরা একমত।’

আগামী সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন চায় বিএনপি। তারা মনে করে, এটাই একমাত্র বৈধ পথ। তবে নির্বাচনের আগে সংস্কার বাস্তবায়নের কোনো বৈধ, আইনানুগ বা সাংবিধানিক পন্থা কেউ বের করতে পারলে বিএনপি তা মানতে রাজি আছে বলেও সালাহউদ্দিন আহমদ উল্লেখ করেন।

সালাহউদ্দিন বলেন, যাঁরা গণপরিষদ চান বা পিআর পদ্ধতি চান, তাঁরা এটা তাঁদের নির্বাচনী ইশতেহারে রাখতে পারেন। জনগণ যদি সেটা গ্রহণ করে, ওই দলগুলো যদি সংসদে যায়, তারা সেটা করবে। কিন্তু একজনের আদর্শ আরেকজনের ওপর চাপানো হবে কেন?

বিএনপির এই নেতা বলেন, পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে দুর্বল সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশে স্থিতিশীলতা আসবে না। নির্বাহী বিভাগকে পঙ্গু করে দেওয়ার মতো কোনো সংস্কার করতে চাইলে মানুষের এজেন্ডা বাস্তবায়ন হবে না। ঐক্য নষ্ট না করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে বিভেদ আবার একটি ভয়ানক পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। কারণ, ফ্যাসিবাদের উত্থান বা প্রত্যাবর্তন হোক, সেটা কেউই চায় না।

জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, জাতীয় নির্বাচন ফেব্রুয়ারি মাসে হতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। নির্বাচন না হলে আগের চেয়ে ভয়ংকর অবস্থায় যেতে হবে। তিনি বলেন, গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদে সাংবিধানিক ভিত্তি দিয়ে ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। তাহলে দেশ বাঁচবে, রাজনীতি বাঁচবে এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা বাঁচবেন।

জামায়াতের এই নেতা বলেন, একটি ছিদ্রপথের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার অভিপ্রায় যেন দেশের সবকিছুকে ধ্বংসের কারণ না হয়। অন্তর্বর্তী সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। আর সব রাজনৈতিক দলকে জনগণের মনোভাব দেখতে হবে।

শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার কথা বলে নির্বাচন হলে তা দেশের গণতন্ত্রকে সুরক্ষা দিতে পারবে না বলে মনে করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি বলেন, নির্বাচন হতে হবে। নির্বাচনের বিষয়ে কোনো সংশয় নেই। যে জায়গায় আটকে আছে, তা হলো জুলাই সনদ, সংবিধান সংস্কার বাস্তবায়নের আলোচনা। নির্বাচনের পর দেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটা এখন ঠিক করা না গেলে নির্বাচন কাঙ্ক্ষিত ফল দেবে না। পরিবর্তনগুলো এখনই হতে হবে। নতুন রাষ্ট্রকাঠামো গঠন করতে হবে। নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায় চব্বিশের অভ্যুত্থানে মানুষ জীবন দিয়েছিলেন, জীবন দেওয়ার জন্য উন্মুখ ছিলেন। জনগণের প্রত্যাশার বিষয়টি মাথায় রেখে সমাধানের পথে যেতে হবে।

রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ আলোচনার টেবিলে বের করা ভালো বলে মনে করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, একটা ধারণা প্রচলিত আছে যে নির্বাচনে বিএনপি জিতে যাবে এবং তারা কিছুই করবে না। এ ধারণার ব্যাপারে বিএনপির নিজের ভাবা উচিত এবং এটাতে আমলে নেওয়া প্রয়োজন।

জোনায়েদ সাকি বলেন, তাঁরা সংবিধানের কাঠামোতে থেকেই সংবিধানের মৌলিক সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এখন বাস্তবায়নের প্রশ্নে নিশ্চয়তা, অনাস্থার বিষয়গুলো আসছে। এ কারণে তাঁরা বলছিলেন যতটুকু জায়গায় ঐকমত্য হয়েছে, তার একটা আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা হোক। সনদ বাস্তবায়নের একটা বাধ্যবাধকতা কিংবা আইনি জায়গা তৈরি করতে পারলে অনাস্থার জায়গাটা দূর হয়। কিন্তু অনাস্থাকে পুঁজি করে নিজস্ব রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষা চাপিয়ে দিতে চাইলে বড় ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি হবে।

যত দ্রুত নির্বাচিত সরকার আসবে, ততই ভালো

অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপের ফলে একটি অনির্বাচিত সরকার সহজে নমনীয় হয়ে যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন ওসমানী সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের চেয়ারম্যান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান। তাঁর মতে, যত তাড়াতাড়ি একটি নির্বাচিত সরকার আসবে, ততই ভালো।

দেশের নিরাপত্তা সংকটের কথা উল্লেখ করে মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের বেশ কিছু প্রথাগত ও প্রথার বাইরের কিছু নিরাপত্তা উদ্বেগ আছে, বিশেষ করে আমাদের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত এলাকায়। এ পর্যায়ে নিরাপত্তা-সংক্রান্ত নীতিগত দিকনির্দেশনা দেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু একটি মধ্যবর্তী বা অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এ ধরনের নীতিগত দিকনির্দেশনা দেওয়া কঠিন হয়ে যায়।’

গত দেড় দশকের কথা উল্লেখ করে সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা বলেন, এই সময়ে সেনাবাহিনীর রাজনীতিকরণ হয়েছে। এর ফলে এ রকম সেনাবাহিনী কার্যকর যুদ্ধযন্ত্র হিসেবে কাজ করতে পারে না। তিনি বলেন, ‘সেই অবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে চাই। সেনাবাহিনীও নিজেদের মৌলিক দায়িত্ব দেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা—সে জায়গায় ফেরত যেতে চায়।’

গোলটেবিল সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।