এবারের নির্বাচনকে একেবারে আদর্শ নির্বাচন বলা যাচ্ছে না

রোববার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তাদের জোটের শরিক মিত্ররা এখন ভোটে। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ও আন্দোলনে থাকা অন্য দলগুলো ভোট বর্জন করেছে। নির্বাচন ও চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে অভিমত প্রকাশ করা হলো

অধ্যাপক আবদুল মান্নান

একটা পক্ষ নির্বাচনকে বানচাল করতে চাইছে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে যেভাবে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছিল, এবার তারা একই কায়দায় চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন মহল, সরকার, রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশন চেষ্টা করেও তাদের স্বাভাবিক পথে আনতে পারেনি বলে মনে করি। আর তারা যেটা চাইছে, তা সাংবিধানিকভাবে অনুমোদন করে না। নির্বাচনকে তারা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নিতে পারত। না নিয়ে তারা বড় ধরনের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে নির্বাচনকে একেবারে আদর্শ নির্বাচন বলা যাচ্ছে না। খুব কঠিন সময়েও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৭৯ সালে জিয়ার সামরিক আইনের ভেতরে থেকেও ছত্রভঙ্গ অবস্থায় নির্বাচনকে আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছিল এবং নির্বাচন করেছিল। ৩৯টি আসনে জয়ী হয়েছিল। এই সুযোগটা বিএনপির ছিল। এবারও ছিল, আগেও ছিল। নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে তারা তা অনুধাবন করতে পারেনি। সেই সুযোগটা এবারও হারাল। শেষমেশ ক্ষতি কিন্তু বিএনপির, তাদের সমর্থকদের আর সার্বিকভাবে রাজনীতির ক্ষতি যে হলো, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

নির্বাচনকে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রক্রিয়া হিসেবে দেখি। এরশাদবিরোধী আন্দোলনে বিএনপির ভূমিকা ছিল। এবার তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি, প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী তারা নাশকতার পথ বেছে নিয়েছে, তা তাদের অনেক ক্ষতি করেছে। বিএনপিতে অনেক গুণী ব্যক্তিত্ব আছেন কিন্তু তাঁরা তাঁদের নেতৃত্বের গুণাবলি নানা কারণে প্রদর্শন করতে পারেননি। এটা বিএনপির জন্য বাজে দৃষ্টান্ত। নির্বাচনের আগে অনেকগুলো ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ ট্রেনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডে পুলিশ একাধিকজনকে গ্রেপ্তার করেছে।

অতীতের যেকোনো নির্বাচন কমিশনের চেয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন অনেক বেশি দৃশ্যমান, শক্তিশালী। নির্বাচনকালীন, নির্বাচনের আগে বা পরে পরিস্থিতি শান্তিপূর্ণ থাকবে কি থাকবে না, তা বিভিন্ন স্টেকহোল্ডার—যেমন প্রার্থী, ভোটার, সরকার, নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্ভর করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করছে, তার ওপর নির্ভর করে। জনগণকে অনেক ভয় দেখানো হচ্ছে, নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড চালানো হচ্ছে। তারপরও আশা করি, অতীতের মতো সব বাধা উপেক্ষা করে নির্ভয়ে মানুষ ভোট দেবে।

নির্বাচন হবে। নির্বাচন হওয়ার পরও সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা যাতে স্বাভাবিক থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচনকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখি।

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিভিন্ন কথা বলে। তাদের গুরুত্ব আছে, তবে একক বা দু–একটি পত্রপত্রিকা কী বলল, তা নিয়ে খুব বেশি মাতামাতি করার কারণ দেখি না। তাদের ডেফিনেশনে ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন হলেও আমাদের ডেফিনেশনে তা ত্রুটিপূর্ণ নাও– হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন, এমনকি তাদের মিত্র মিসরে সম্প্রতি যে নির্বাচন হলো, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, না ওদের কিছু বলা যাবে না, ওরা আমাদের কৌশলগত মিত্র। সারা বিশ্বে নির্বাচনের জন্য গ্রহণযোগ্য কোনো প্যারামিটার নেই। বিদেশি পত্রপত্রিকা কী বলল, তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে দেশের মানুষ কী বলছে।

আমি সব সময় আশাবাদী মানুষ। সরকার এবার উন্মুক্ত করে দিয়েছে, দলের বাইরে গিয়েও কেউ নির্বাচন করতে পারবে। এটার ভালো দিক হচ্ছে, ক্ষমতায় যাঁরা বিভিন্ন পদে থাকেন, তাঁরা ধরেই নেন যে বিজয়ী হবেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এবার নিজের যোগ্যতায় নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। তৃণমূলের সমর্থনে যাঁরা জয়ী হয়ে আসবেন, সেটাই ক্ষমতাসীন দলের জন্য দলকে পরিশীলিত আর পরিপক্ব করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

অস্বীকার করার উপায় নেই, দীর্ঘ সময় কোনো দল ক্ষমতায় থাকলে দলের মধ্যে অনেক আগাছা, পরগাছা জন্ম নেয়। এই স্বতন্ত্র কৌশলে এদের চিহ্নিত করে বাতিল করে দেওয়ার একটি বড় সুযোগ তৈরি করবে। দেশ কোন দিকে যায়, তা নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর। একক ব্যক্তির নেতৃত্ব নয়; দেশের সামষ্টিক নেতৃত্বের ওপর এটি নির্ভর করে।

আমি মনে করি, এবারের নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হচ্ছে। দুটি বা তিনটি দলের মধ্যে এখন আর নির্বাচন সীমাবদ্ধ নেই। আমি যে কথাটা গুরুত্ব দিয়ে বলতে চাই তা হচ্ছে, যারা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে তাদের বুঝতে হবে, সন্ত্রাস দিয়ে রাজনীতিতে খুব বেশি দূর অগ্রসর হওয়া যায় না। তার বড় প্রমাণ ৭০ দশকের ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলন, তারা কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।