অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ সব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা এনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন: কামাল হোসেন
গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দায়িত্বে আসা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে সংস্কারের যে আকাঙ্ক্ষা সৃষ্টি হয়েছে, তা উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সরকারকে দক্ষতার সঙ্গে বিষয়গুলো সমাধানের জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
সোমবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত এক শোকসভায় লিখিত বক্তব্যে এসব কথা বলেন গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন। তাঁর বক্তব্য পড়ে শোনান গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও গণফোরামের সাবেক সভাপতি মোস্তফা মোহসীন মন্টু স্মরণে এই শোকসভার আয়োজন করা হয়।
আওয়ামী লীগের শাসনের ১৫ বছর গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় মোস্তফা মোহসীন মন্টু সক্রিয়ভাবে রাজপথের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সব আন্দোলনে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। সর্বশেষ জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানেও মোস্তফা মোহসীন সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছেন। তিনি সব সময় স্বপ্ন দেখতেন, মুক্তিযুদ্ধের কাঙ্ক্ষিত একটি বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার। সে লক্ষ্যে তিনি সব সময় জাতীয় ঐক্যের জন্য কাজ করে গেছেন।
বর্তমান বাংলাদেশের অস্থিরতা ও সংকট নিরসনের একমাত্র পথ রাজনৈতিক ঐক্য বলে উল্লেখ করেন কামাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘এই ঐক্যের ভিত্তি হলো আমাদের জাতীয় চেতনা। এই চেতনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাহাত্তরের সংবিধান ও চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে নিহিত। মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছিল, সাম্য, মানবিক ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বিগত ৫৩ বছরে এই অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠিত হয়নি।’
শোকসভা শেষে শুভেচ্ছা বক্তব্যে ড. কামাল হোসেন বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর আমরা যে পরিবর্তনের কথা বলছি, সেটার জন্য মাঠে ঐক্যের প্রয়োজন। বর্তমান যে সংকট চলছে, তা ঐক্যের মাধ্যমে নিরসন সম্ভব। তাই বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দৃঢ়প্রতিজ্ঞার মধ্য দিয়ে কেবল আমাদের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন অর্জন করা সম্ভব।’
গত ১৫ জুন মোস্তফা মোহসীন মন্টু রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা জেলা গেরিলা বাহিনীর প্রধান ছিলেন তিনি। ঢাকা-৩ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু।
‘কিছু মহল মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র করছে’
প্রয়াত মোস্তফা মোহসীন মন্টুকে আপাদমস্তক দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ বলে অভিহিত করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী অসংখ্য আন্দোলনে তাঁরা একসঙ্গে রাজপথে লড়াই করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের বিষয়ে এই রাজনীতিবিদের কোনো আপস ছিল না। তাঁর প্রয়াণ দেশের জন্য বড় ক্ষতি। তিনি দেশপ্রেমের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন, তা বর্তমান রাজনীতিবিদদের ধারণ করা উচিত। তাহলে দেশ উপকৃত হবে।
কিছু মহল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ষড়যন্ত্র করছে বলে উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেন, ‘বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আমাদের কোনো আপস নেই। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে বিএনপি প্রস্তুত আছে।’
অন্তর্বর্তী সরকারের সব সংস্কার কমিশনকে বিএনপি সহযোগিতা করছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রকাঠামোর পরিবর্তনের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে। এই সুযোগকে কাজে লাগাতে সরকারের সংস্কার আলোচনায় বিএনপি নিয়মিত প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে একটি মহল প্রচার করছে, বিএনপি নাকি সংস্কারকে আটকে দিচ্ছে। কিন্তু আমরা মনে করিয়ে দিতে চাই, বিএনপিই প্রথম সংস্কারের বাস্তবতা উপলব্ধি করেছিল।’
নির্বাচনকে পিছিয়ে দিতে সুপরিকল্পিতভাবে একটা মহল চক্রান্ত করছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা অন্তত আশাবাদী যে প্রধান উপদেষ্টা ও তারেক রহমানের লন্ডনে যে আলোচনা হয়েছিল, সে অনুযায়ী ফেব্রুয়ারির মধ্যে নির্বাচন হবে। আমরা সেটাকে বিশ্বাস করছি। কারণ, আমরা যেভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর পরিবর্তন করতে চাই, সেটার জন্য আমাদের ঐক্য প্রয়োজন। সেই ঐক্য গঠিত হবে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে।’
বর্তমান পরিস্থিতি দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে উল্লেখ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সঠিক পথে না চললে আবারও সবাই বিপদের মুখে পড়বে। গণ-অভ্যুত্থানের বছর পেরোনোর আগে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা আবার অপেক্ষায় রয়েছি। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, সেটা নষ্ট করার জন্য একটি মহল মাঠে নেমেছে।’
পুরান ঢাকায় ভাঙারি পণ্যের ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে (৩৯) নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনাকে ষড়যন্ত্রের অংশ উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনায় যারা জড়িত, তারা গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করছে। আগামী দিনে আপনারা আরও অনেক কিছু দেখবেন। যারা এই প্রজেক্টে জড়িত, তারা নির্বাচন চায় না।’
‘পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায় ছন্দপতন হয়েছে’
শোকসভায় অংশ নিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘বিভিন্ন মহল কিছু কিছু কাজ করছে, যেটা বিভিন্ন বিতর্ক তৈরি করছে। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান আমাদের মধ্যে যে পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করেছিল, এখন সেটার ছন্দপতন হয়েছে। সম্প্রতি নতুন করে আমাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তবুও আমরা আশা করি, নতুনভাবে দেশ গড়তে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব।’
সভায় গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম গৌরব শুধু ফ্যাসিবাদের বিলুপ্তি নয়, নতুন রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগ। নব্বইয়ে যে কাজটি হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলো এখন একটি জায়গায় এসেছে, বিদ্যমান কাঠামো ইতিপূর্বে তাঁদের দূরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল। এই দেশে আমরা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই। সেটার জন্য গণতান্ত্রিক বন্দোবস্তে আমাদের যেতে হবে। সংস্কার প্রশ্নে এখন পর্যন্ত যে রোডম্যাপ (পথনকশা) আছে, তাতে আমরা ঠিকঠাক পথেই আছি বলে মনে হয়। তবে ফ্যাসিবাদী কাঠামো বিলুপ্তিতে আমাদের ন্যূনতম ঐক্য গড়তে হবে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ‘বিশাল যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অহংকার আমরা করছি, বাস্তবে আমরা সাধারণ মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ লক্ষ করছি। সমাজে নারীদের অবস্থা আরও করুণ। আমরা নানা রকমের বন্দোবস্তের কথা বললেও প্রকৃতপক্ষে সবাই নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ে বেশি তৎপর।’
শোকসভায় বাবার স্মৃতিচারণা করেন মোস্তফা মোহসীন মন্টুর কন্যা শ্রাবণী মোস্তফা। তিনি বলেন, তাঁর বাবা ছিলেন আপসহীন, নির্ভীক ও দেশপ্রেমিক। তিনি সব সময় সাহসের সঙ্গে সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করে গেছেন। দেশপ্রেম কতটা গভীর হতে পারে, তার প্রকৃত উদাহরণ মোস্তফা মোহসীন মন্টু।
গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সঞ্চালনায় শোকসভায় আরও বক্তব্য দেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন (প্রিন্স), বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ, এবি পার্টির ভাইস চেয়ারম্যান মো. দিদারুল আলম, ভাসানী জনশক্তি পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল কাদের, বাংলাদেশ জাসদের (আম্বিয়া) সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া, গণফোরামের সভাপতি ফোরাম সদস্য সুরাইয়া বেগম, এ কে এম জগলুল হায়দার, সুব্রত চৌধুরী প্রমুখ।