জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সরকারের শেষ চেষ্টা, বিএনপি–জামায়াত–এনসিপি কী ভাবছে
সমাধান খোঁজার চেষ্টা
উপদেষ্টারা নিয়মিত বসছেন।
প্রধান উপদেষ্টা আজ কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে বসতে পারেন।
দাবিগুলো কিছুটা সমন্বয় করে সমাধান বের করার চেষ্টা।
১৫ নভেম্বরের মধ্যে আদেশ জারি করতে চায় সরকার।
সরকার আহ্বান জানালেও জুলাই জাতীয় সনদের সংবিধান-সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো আলোচনা হয়নি। বড় দুই দলই জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও গণভোটের সময় নিয়ে নিজ নিজ অবস্থানে অটল। এ বিষয়ে সৃষ্ট জট খুলতে সরকারের শেষ চেষ্টা কতটা সফল হবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে গেছে।
সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে দলগুলোকে নিজ উদ্যোগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে ঐক্যবদ্ধ দিকনির্দেশনা দেওয়ার জন্য সাত দিনের সময় দিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। গতকাল সোমবার সে সময় শেষ হয়েছে। এখন এ বিষয়ে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশকে ভিত্তি ধরে একটি সিদ্ধান্ত দেবে সরকার। দলগুলোও সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে।
সরকারের সংশ্লিষ্ট একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে উপদেষ্টারা নিজেরা নিয়মিত আলোচনা করছেন। আজ মঙ্গলবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস কয়েকজন উপদেষ্টার সঙ্গে এ নিয়ে বৈঠক করতে পারেন।
সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করা এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চায় সরকার।
সূত্র জানায়, সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে একটি খসড়া প্রায় চূড়ান্ত করেছে সরকার। আগামী বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার কথা। ১৫ নভেম্বরের মধ্যে সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করতে চায়। রাজনৈতিক দলগুলোর দাবিদাওয়ার মধ্যে কিছুটা সমন্বয় করে সমাধান বের করার চেষ্টা চলছে। এ ক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচন ও জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট একই দিনে করা এবং সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব (পিআর) পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে চায় সরকার।
এদিকে বিএনপি সূত্র জানায়, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে সরকারের এ উদ্যোগকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনসহ যেসব সংস্কার প্রস্তাবে বিএনপির ভিন্নমত আছে, সেগুলো নিয়ে নতুন করে আর আলোচনার সুযোগ আছে বলেও মনে করে না দলটি। তারা মনে করে, সংস্কার বা সনদ নিয়ে আলোচনার ‘চ্যাপ্টার ক্লোজড’।
বিএনপির পূর্ণ মনোযোগ এখন ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচনের দিকে। তারা জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোটের দাবিতে অনড়। আর সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী আদেশ জারি নিয়ে বিএনপির আপত্তি আছে। তারা ক্ষমতায় গেলে নিজেদের ভিন্নমত অনুসারে সংবিধান সংস্কার করতে চায়।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী চায়, দ্রুত জুলাই সনদ বাস্তবায়নের আদেশ জারি করা হোক। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই গণভোট চায় দলটি। জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে বড় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল।
জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) আরও কিছু দল মনে করে, এখানে সরকারকে শক্ত ভূমিকা নিতে হবে। সরকার সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারলে সংকট ও অনিশ্চয়তা কেটে যাবে।
বিএনপি সূত্র জানায় তারা মনে করে, সংস্কার বা সনদ নিয়ে আলোচনার ‘চ্যাপ্টার ক্লোজড’।
কমিশনের সুপারিশ
৩০টি দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ৬টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে তৈরি করা হয়েছে জুলাই জাতীয় সনদ। ৮৪টি প্রস্তাবের মধ্যে ৪৮টি সংবিধান-সম্পর্কিত। সংবিধান-সম্পর্কিত প্রস্তাবগুলোর অন্তত ৩৬টিতে কোনো না কোনো দলের ভিন্নমত আছে।
প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে গত ২৭ অক্টোবর সরকারের কাছে দুটি বিকল্প সুপারিশ দেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর কোনোটিতেই ভিন্নমতের বিষয়টি রাখা হয়নি। সুপারিশ অনুযায়ী, প্রথমে ‘জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ’ জারি করা হবে। এরপর ওই আদেশ ও ৪৮টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে হবে গণভোট। গণভোটে হ্যাঁ জয়ী হলে আগামী সংসদ সংবিধান সংস্কার পরিষদ হিসেবে ২৭০ দিনের মধ্যে সংবিধান সংস্কার করবে। বিকল্প সুপারিশে বলা হয়েছে, এ সময়ের মধ্যে সংসদ সংবিধান সংস্কারে ব্যর্থ হলে প্রস্তাবগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হবে। গণভোট কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী ও এনসিপি ঐকমত্য কমিশনের এই সুপারিশকে ইতিবাচকভাবে নিলেও বিএনপি তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। বিশেষ করে ভিন্নমতের বিষয়টি না রাখাকে প্রতারণা হিসেবে দেখছে দলটি।
জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে আজ মঙ্গলবার রাজধানীর পল্টনে বড় সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামীসহ আট দল।
বিএনপির অবস্থান
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে কোনো আদেশ জারি করার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই বলে মনে করে বিএনপি। দলটি মনে করে, জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা যায়, তার ভিত্তিতে একটি নতুন অধ্যাদেশ করে গণভোট হবে। তারা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে গণভোট করার পক্ষে। দলটি মনে করে, এটি হলে আগামী সংসদকে আলাদা কোনো ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজন হবে না। সনদ বাস্তবায়ন বাধ্যতামূলক হবে।
ভিন্নমতের বিষয়ে বিএনপির অবস্থান হলো, কোন কোন প্রস্তাবে কোন কোন দলের ভিন্নমত আছে, সেগুলো জুলাই সনদে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করে যদি জনগণের ম্যান্ডেট পায়, তাহলে তারা সেইমতো ব্যবস্থা নিতে পারবে। সুতরাং গণভোটে সনদ বাস্তবায়নের পক্ষে হ্যাঁ জয়যুক্ত হলে যারা জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হবে, তারা ভিন্নমত অনুসারেই সনদ বাস্তবায়ন করতে পারবে।
বিএনপির সূত্র জানায়, দলটি এই অবস্থান থেকে সরছে না। বিশেষ করে ভিন্নমত এবং গণভোটের সময় নিয়ে কোনো ছাড় দেওয়ার পক্ষে নয় তারা।
একই দিনে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন হলে বিএনপি উচ্চকক্ষে পিআর মেনে নেবে, এমনটা আশা করছে সরকার। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের কোনো প্রস্তাব তাঁরা সরকারের কাছ থেকে পাননি। যদি সরকার কোনো প্রস্তাব দেয় তখন তাঁরা এ বিষয়ে কথা বলবেন।
রাজপথে জামায়াত
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ করেছে, তার সঙ্গে একমত জামায়াতে ইসলামী। তবে দলটি জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট করার দাবিতে অনড়। আদেশ জারি, আগে গণভোটসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজপথে আন্দোলন করেছে জামায়াতসহ আট দল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জামায়াতে ইসলামী চায়, ঐকমত্য কমিশন যেভাবে সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে, সেভাবেই বাস্তবায়ন করতে হবে। এখানে দলগুলোর ভিন্নমত গুরুত্ব পাবে না। বিশেষ করে পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠন, সাংবিধানিক পদগুলোয় নিয়োগের বিধান সংবিধানে যুক্ত করার মতো কিছু মৌলিক পরিবর্তনে ছাড় দেওয়ার পক্ষে নয় তারা।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, সংকট নিরসনে আলোচনার দরজা সব সময় উন্মুক্ত আছে। সরকার বা রাজনৈতিক দলগুলো এ উদ্যোগ নিতে পারে। কিন্তু জুলাই সনদে হাত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। তবে সনদের বাস্তবায়ন বিষয়ে আলোচনার মধ্য দিয়ে সংকট উত্তরণের রাস্তা বের করে আনা উচিত।
সাহসী সিদ্ধান্ত চায় এনসিপি
জুলাই সনদ বাস্তবায়নে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ ইতিবাচকভাবে নিয়েছে এনসিপি। কিন্তু কমিশন সুপারিশ দেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন না করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার আহ্বানকে সরকারের গা বাঁচানোর মনোভাব বলে মনে করে দলটি। উচ্চকক্ষে পিআরসহ বিভিন্ন মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য কমিশন যেভাবে প্রস্তাব দিয়েছে সেভাবে বাস্তবায়ন চায় এনসিপি। গণভোটের সময় নিয়ে দলটির কঠোর অবস্থান নেই। তারা মনে করে, সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা থাকলে গণভোট সংসদ নির্বাচনের দিনও হতে পারে বা আগেও হতে পারে।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার সংস্কারের ম্যান্ডেট নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে। তাই জুলাই সনদের পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা তাদের কর্তব্য। সরকারকেই সবচেয়ে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার যদি জুলাই সনদ বাস্তবায়নে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তাহলে রাজনৈতিক সংকট এবং নির্বাচন নিয়ে অনিশ্চয়তা কেটে যাবে।
কমিশন সুপারিশ দেওয়ার পর তা বাস্তবায়ন না করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনার আহ্বানকে সরকারের গা বাঁচানোর মনোভাব বলে মনে করে দলটি।