কর্মী-সমর্থক ও প্রশাসনে ভীতি কাটাতে সচেষ্ট আ.লীগ

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি এবং প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ছয় কংগ্রেসম্যানের চিঠি—এই ঘটনাপ্রবাহকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বড় ধরনের চাপ হিসেবে দেখছে আওয়ামী লীগ। সামনের দিনগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে চাপ আরও বাড়তে পারে—এমনটা ধরে নিয়ে নিজেদের কৌশল সাজাচ্ছে আওয়ামী লীগ। এ ক্ষেত্রে দলটির মূল লক্ষ্য, প্রশাসন, দলের নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের মধ্যে যাতে বিরূপ প্রভাব না পড়ে, সেটা নিশ্চিত করা।

আর এ চিন্তা থেকে ক্ষমতাসীনেরা মাঠে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি আরও বাড়াতে চাইছে। দলটির নেতারা বলেছেন, এখন ১৪–দলীয় জোটের ব্যানারেও ধারাবাহিকভাবে সভা-সমাবেশ তাঁরা করবেন।

প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা গত শনিবার মার্কিন ভিসা নীতি নিয়ে তাঁর অবস্থানের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এ নিয়ে মাথাব্যথা করে লাভ নেই। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ অন্য নেতারাও বক্তব্য-বিবৃতিতে বলছেন, মার্কিন ভিসা নীতি বিএনপির জন্যই ক্ষতির কারণ হয়েছে।

তবে আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। যদিও দলীয় প্রধান ও শীর্ষ নেতাদের বক্তব্য, ব্যক্তিগত যোগাযোগ ও নেতাদের একে অপরের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কিছু কৌশলের বিষয় এসেছে।

আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা বলছেন, ভিসা নীতি ও কংগ্রেসম্যানদের চিঠি নিয়ে সরকারের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়েছে—এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছে বিএনপিসহ অন্য বিরোধী দলগুলো। ভবিষ্যতেও বিরোধী দল এ ধরনের প্রচার অব্যাহত রাখবে। আওয়ামী লীগ পাল্টা বক্তব্য নিয়ে মাঠে না থাকলে নেতা-কর্মীদের মনোবলে চিড় ধরতে পারে।

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের পর থেকে বিএনপির কর্মসূচির পাল্টা কর্মসূচি পালন এবং তাদের বক্তৃতার জবাব দেওয়ার কারণে বিএনপি তেমন সুবিধা করতে পারেনি। এখনো ভিসা নীতি নিয়ে বিএনপির প্রচারণার বিপরীতে আওয়ামী লীগের পাল্টা বক্তব্য তুলে ধরা প্রয়োজন।

মার্কিন ভিসা নীতির বিষয়টি গত রোববার আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪–দলীয় জোটের বৈঠকেও আলোচনা হয়েছে। সেই বৈঠক থেকে জোটগতভাবে সমাবেশের কর্মসূচি বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

ধারাবাহিক চাপ দেখছে আ.লীগ

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র‍্যাবের সাবেক ও সেই সময় কর্মরত সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে, চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় দফার গণতন্ত্র সম্মেলনেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।

সর্বশেষ গত ২৪ মে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার লক্ষ্যে একটি নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। নতুন নীতিতে নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িতদের বিরুদ্ধে বিধিনিষেধের কথা বলা হয়েছে। গত ২৫ মে ছয়জন কংগ্রেসম্যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে একটি চিঠিও লিখেছেন। সেই চিঠিতে তাঁরা বাংলাদেশের সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা যাতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন, সে জন্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুরোধ জানিয়েছেন।

এসব বিষয়ে গত রোববার আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পাঁচ নেতার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের মূল বক্তব্য হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রথমে র‍্যাবের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এরপর এল ভিসা নীতি, কংগ্রেসম্যানদের চিঠি। অর্থাৎ তারা ধারাবাহিক একটা প্রক্রিয়া অবলম্বন করছে। এ থেকে আশঙ্কা, নির্বাচনের আগে আরও নানা চাপ আসতে পারে।

ওই নেতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নেওয়া এসব পদক্ষেপের মূল লক্ষ্য মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও সরকার। যদিও তারা বলছে, এটা কোনো দলকে লক্ষ্য করে দেওয়া হয়নি।

আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র একটি রাজনৈতিক অবস্থান নিয়েছে। এর সমাধান হয়তো কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমেই করতে হবে। তবে তা শিগগিরই সম্ভব হবে না। তাই সরকার ও আওয়ামী লীগকে কৌশলী হয়ে এগোতে হবে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য মিত্রদের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা চালাতে হবে, যাতে ক্ষতি আর না বাড়ে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিদেশি বন্ধুরা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। আওয়ামী লীগও সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। ফলে, ভিসা নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের তো চিন্তার কারণ নেই। বরং যারা নির্বাচন চায় না, তাদের চিন্তার কারণ আছে।

বিরোধীদের প্রচারের পাল্টা

আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে—সরকার ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ কথা দেশে-বিদেশে জোরের সঙ্গেই বলা হচ্ছে। গাজীপুরের ভোটের পর সরকার যে সেই পথেই আছে, সেটা প্রকাশ পেয়েছে। আরও চারটি সিটি করপোরেশনে সুষ্ঠু ভোট হবে। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগও সুষ্ঠু নির্বাচন চায় এবং সেই পথে আছে। ফলে দুই পক্ষ একই লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে—এ প্রচারই বেশি করে করতে চায় আওয়ামী লীগ।

এ ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে না এলে আগের মতো ভোট ভন্ডুলের চেষ্টা চালাবে। এমনটা করলে তারাই বেশি ভিসা নীতির শিকার হবে—এই বক্তব্যও সামনে আনতে চায় আওয়ামী লীগ।

এসব প্রচার নিয়েই আওয়ামী লীগ ভোটের আগপর্যন্ত নিজেরা এবং জোটগতভাবে জনগণকে সংগঠিত করার দিকে মনোযোগ বাড়াবে। সভা-সমাবেশ অব্যাহত রাখবে। বেশি বেশি লোক জমায়েতের চেষ্টা চালাবে।

আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সরকার টানা ১৫ বছর যে ক্ষমতায় আছে, তা বিদেশিদের শক্তির ওপর ভর করে নয়। দেশের ভেতরের শক্তিই মূল শক্তি। বিদেশি শক্তিরও সমর্থন পেয়েছে আওয়ামী লীগ। তাই আওয়ামী লীগ এখনো দেশের শক্তির ওপর বেশি জোর দিচ্ছে। যত বেশি সম্ভব বিদেশি বন্ধুদের পাশে রাখার চেষ্টাও তাদের থাকবে। এ সবকিছুর মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে ভোটের চ্যালেঞ্জ পার করতে হবে।