এই চায়নিজ রাইফেলটা এল কোত্থেকে: মির্জা ফখরুল

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশে বক্তব্য দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নারায়ণগঞ্জে যুবদল কর্মী শাওন প্রধানকে গুলি করার জন্য ডিবি পুলিশের এসআই মাহফুজুর রহমানকে (কনক) দায়ী করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘এই এসআই কনকের চায়নিজ রাইফেল রাখার কোনো এখতিয়ার ছিল না। তাহলে এই চায়নিজ রাইফেলটা এল কোত্থেকে। কোন আদেশ বলে সে গুলি করে হত্যা করল আমার ভাইকে।’

যুবদল কর্মী শাওন প্রধান হত্যার প্রতিবাদে আজ শনিবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির এক সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম এ কথা বলেন। সরকারের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘আমরা পরিষ্কার করে জানতে চাই, নারায়ণগঞ্জে বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে কী কারণে সরকারের পেটুয়া বাহিনী গুলি করেছে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘দুই দিন ধরে নারায়ণগঞ্জের এসপি, আওয়ামী লীগের নেতারা বোঝানোর চেষ্টা করছেন, এই ছেলেটা যুবদলের ছেলে নয়, ওয়েল্ডিং ফ্যাক্টরিতে কাজ করত। যদি তর্কের স্বার্থে ধরেও নিই যে সে যুবদলের কর্মী নয়, একটা ওয়ার্কশপের কর্মী। তাহলে এই সরকার, পুলিশকে সেই এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে একটা মানুষকে বিনা কারণে গুলি করে হত্যা করার?’

এ সময় মির্জা ফখরুল ইসলাম নারায়ণগঞ্জে শাওন নিহত হওয়ার ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আজকের একটি প্রতিবেদন উঁচিয়ে দেখান। তিনি এসআই মাহফুজুর রহমানের ছবি দেখিয়ে বলেন, ‘এই সভা থেকে আমরা দাবি করছি, এই ছবির তদন্ত করা হোক এবং এই রাইফেল নিয়ে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক গুলি করেছে, তার তদন্ত করে তাকে আইনের আওতায় এনে সাজা দিতে হবে।’

সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘যদি সাজা না দেন, আমরাও বসে থাকব না, বসে নেই। ভোলাতে মামলা করেছি, নারায়ণগঞ্জেও মামলা করব। যতবার আপনারা আইন ভঙ্গ করবেন, আমার ভাইদের ওপর অত্যাচার করবেন, ততবার মামলা হবে। ভাবছেন ক্ষমতায় আছেন, মামলায় কী হবে। মামলায় হয়, মামলায় খুবই হয়।’

আইজিপি বেনজীর আহমেদের নাম উল্লেখ না করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আজ দেখুন, আপনাদের প্রধান আমেরিকায় গেছেন, তাঁকে শর্ত মেনে যেতে হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে যে সুনির্দিষ্ট এলাকা, জাতিসংঘের ক্যাম্পাসের বাইরে তুমি যেতে পারবে না। এটা লজ্জা আমাদের জন্য। একটা স্বাধীন–সার্বভৌম দেশের জন্য কত বড় লজ্জার কথা যে আজ পুলিশপ্রধানকে শর্ত সাপেক্ষে ভিসা নিয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে। কেউ রক্ষা করতে পারে না। যারাই অত্যাচার করেছে, নির্যাতন করেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে, তাদের কেউই রক্ষা পায়নি।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের হাইকমিশনারের ঢাকা সফর নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করার অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, তিনি এখানকার ভিকটিম, সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, সর্বশেষ চারজন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে যাওয়ার আগে প্রেস কনফারেন্স করলেন। তিনি খুব স্পষ্ট করে বললেন, বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে, গুম হচ্ছে, বিচারবহির্ভূত হত্যা হচ্ছে, পুলিশ কাস্টডিতে হত্যা করা হচ্ছে। বলেছেন, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের যদি সুষ্ঠু তদন্ত করা না যায়, তাহলে তাদের একদিন না একদিন জবাব দিতে হবে।

নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশের একাংশ
ছবি: প্রথম আলো

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এরপর তিনি আরেকটা ইঙ্গিত দিয়েছেন, যে ইঙ্গিতটা আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্য অত্যন্ত সতর্কতামূলক ইঙ্গিত। সেই ইঙ্গিতে কী বলেছেন? বাংলাদেশের সেনাবাহিনী বিশ্বের শান্তিরক্ষার স্বার্থে শান্তি মিশনে কাজ করে। এই মিশনে যাঁরা কাজ করেন, সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, তাঁদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের কোনো ঘটনা আছে কি না, সেটি জাতিসংঘ দেখতে চায়। এই কথা অত্যন্ত বড় সতর্কবাণী। তিনি আওয়ামী লীগ সরকারকে দেশের বিচার, প্রশাসন, সংসদ, অর্থনীতি ধ্বংস করা এবং গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করে রাখার জন্য অভিযুক্ত করেন।’

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘এই ছেলেটাকে (শাওন) সোজাসুজি গুলি করা হয়েছে। বিনা নির্দেশে এই গুলি হতে পারে না। এই নির্দেশ যে–ই দিয়ে থাকুক, জনরোষ থেকে আপনারা মুক্তি পাবেন না। নাম পাওয়া গেছে, একজন কনক। আমরা একাত্তর সালে যুদ্ধের সময় এই অস্ত্র চিনেছি, চায়নিজ রাইফেল। এই যুদ্ধাস্ত্র মিছিল ধ্বংস করার জন্য সরকার কীভাবে ব্যবহার করে, আমি জানতে চাই।’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একটি রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী, যাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রের জনগণকে রক্ষা করা, জনগণের নিরাপত্তা দেওয়া, নাগরিকের সাংবিধানিক, গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক অধিকার রক্ষা করা। এখন সেই পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করে সেই নাগরিকের ওপর প্রতিনিয়ত গুলি চালানো হচ্ছে। একটি অবৈধ সরকারকে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য এই কাজ করা হচ্ছে। এর কারণ, দখলদার সরকার এমন দেউলিয়া হয়ে গেছে যে তারা বিরোধী দলগুলোকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করার অবস্থায় নেই।

বিএনপিকে মিছিল-মিটিংয়ে বাধা না দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যের উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, এই অধিকার তো প্রধানমন্ত্রীর দেওয়ার কোনো কারণ নেই। এই অধিকার সংবিধানে সুস্পষ্টভাবে দেওয়া আছে। প্রধানমন্ত্রী যখন এ কথা বলেন, এর মর্মবাণী কী? যাদের উদ্দেশে বলেছেন, সেই ছাত্রলীগ, যুবলীগ, পুলিশ লীগ—তারা প্রধানমন্ত্রীর এই কথার মর্মবাণী বুঝেছে। আর তা হচ্ছে, এদের (বিএনপি) সভা-সমাবেশ করতে দেওয়া যাবে না।

সরকারি দলের নেতাদের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে বিএনপির এই নেতা বলেন, তারা নাকি মোকাবিলা করবে রাস্তায়। আরে এটা কি বক্সিং রিং? এখানে মোকাবিলা করার জন্য বক্সিং খেলা হচ্ছে? বিএনপি-আওয়ামী লীগ তো এখানে বক্সিং খেলছে না। মোকাবিলা করতে হবে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে। তারা যদি রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চায়, তাহলে জনগণের কাছে যাওয়া ছাড়া মোকাবিলার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তাদের তো মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম-খুন, ভোট চুরির কারণে জনগণের কাছে যাওয়ার মুখ নেই।

সমাবেশে বিএনপির নেতা-কর্মীরা খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে মহানগরের বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে নয়াপল্টনে জড়ো হন। এতে দুপুরের আগে থেকেই নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ভিআইপি রোডের এক পাশে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আবদুস সালামের সভাপতিত্বে সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন দলের মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভূঁইয়া, জয়নুল আবদিন, দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুবদলের সুলতান সালাহউদ্দিন, মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্যসচিব আমিনুল হক, দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল আলম প্রমুখ।