সারা দেশে বিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ আপাতত বন্ধ

চিঠি ফাঁস হওয়ায় সারা দেশে বিএনপিসহ বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের তথ্য সংগ্রহের কাজ বন্ধ রেখেছে পুলিশ।

  • নতুন করে তথ্য সংগ্রহ করা হবে গোপনীয়তা নিশ্চিত করে।

  • রাজধানীতে তথ্য সংগ্রহ চলছে।

  • বিএনপির অভিযোগ, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে দমন– পীড়নের লক্ষ্যে এই তালিকা হচ্ছে। 

অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারায় সারা দেশে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের তথ্য সংগ্রহ ও তালিকা তৈরির কাজটি আপাতত বন্ধ রেখেছে পুলিশ। যাতে গোপনীয়তা বজায় থাকে, সেই প্রক্রিয়া ঠিক করে কাজটি নতুনভাবে শুরু করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে।

বিএনপি, জামায়াতসহ সরকারবিরোধী দল ও সংগঠনের নেতাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য গত মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সারা দেশে জেলা পর্যায়ে পুলিশকে নির্দেশনা পাঠায় পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি)। এই খবর সম্প্রতি জানাজানি হলে অস্বস্তিতে পড়ে পুলিশ। বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, আগামী জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিরোধী দলকে দমন–পীড়নের লক্ষ্যে পুলিশ সারা দেশে তালিকা করছে।

যদিও পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এবং সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মনজুর রহমান গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এসবি এ ধরনের তথ্য সংগ্রহ করে থাকে। সম্প্রতি আলোচনায় আসা চিঠিতে যা–ই উল্লেখ করা হোক না কেন, এসবি সব রাজনৈতিক দলের তথ্য সংগ্রহ করে এবং নিয়মিত সেই তথ্য হালনাগাদও করে।

পুলিশ সূত্র জানায়, বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের জন্য গত ২২ সেপ্টেম্বর এসবির প্রধান কার্যালয়ের রাজনৈতিক শাখা থেকে সব জেলার পুলিশ সুপার এবং মহানগরের পুলিশ কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠানো হয়।

রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। যদি শুধু সরকারবিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাহলে রাজনৈতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়।
অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন

সেই নির্দেশনার আলোকে রাঙামাটির পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে থানার ওসিদের (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) কাছে পাঠানো এ–সংক্রান্ত বার্তা ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর ৭ অক্টোবর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সংবাদ সম্মেলনে বিষয়টি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ পুলিশের এসবির (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) প্রধান কার্যালয়ের বরাত দিয়ে রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার (এসপি–ডিএসবি) গত ২৫ সেপ্টেম্বর একটি বেতার বার্তা (নম্বর ৩৯০৯, রাজনৈতিক) পাঠিয়েছে। ওই বার্তায় বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের কমপক্ষে আটজন শীর্ষ ব্যক্তি (জেলা পর্যায়ের নেতা), প্রতি উপজেলার পাঁচজন শীর্ষ নেতা এবং পৌর সভা ও ইউনিয়নের পাঁচজন ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়েছে। যাঁরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ‘জনবল সংগঠক’বা ‘অর্থায়ন করেন’ কিংবা অন্য কোনোভাবে সহায়তা করেন। এঁদের বিস্তারিত তথ্য, যেমন ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর, এনআইডি (জাতীয় পরিচয়পত্র) নম্বর ইত্যাদি সংগ্রহ করে ই–মেইলে এবং পরে হার্ড কপি (কাগজে) পাঠাতে জেলার সব থানার ওসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রাঙামাটি জেলা পুলিশের দেওয়া এমন একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে। এই বার্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি জেলার পুলিশ সুপার কাজী আবু তৌহিদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই বার্তাটি কে দিয়েছেন, সেটা আমরা তদন্ত করে দেখছি।’

ময়মনসিংহ বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ উপলক্ষে রাতেই শত শত নেতাকর্মী নগরের পলিটেকনিক মাঠে অবস্থান নেন। শুক্রবার রাত ১০টার দিকে
ছবি: প্রথম আলো

ঢাকায় এসবির প্রধান কার্যালয়ের একটি সূত্র বলছে, বিএনপি–জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতা–কর্মীদের তথ্য সংগ্রহের গোপন চিঠি এভাবে প্রকাশ্যে চলে আসায় বিষয়টি নিয়ে পুলিশ কিছুটা অস্বস্তিতে পড়েছে। তথ্য সংগ্রহে গোপনীয়তা রক্ষা করতে না পারায় চিঠিটি প্রত্যাহার করা হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এসবির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তথ্য সংগ্রহের এই কাজটি আপাতত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কাজটি করা হবে, তবে গোপনীয়তা বজায় রেখে নতুন প্রক্রিয়ায়।

আরও পড়ুন

সারা দেশের এই কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রাখা হলেও রাজধানী ঢাকায় সেটা চলমান রয়েছে। ঢাকা মহানগরের (ডিএমপি) গত জুলাই মাসের অপরাধ পর্যালোচনা সভায় বিরোধী রাজনৈতিক দলের রাজধানীর প্রত্যেক থানায় মহল্লাভিত্তিক কমিটির তালিকা, নেতাদের নাম–ঠিকানা, পদ, মোবাইল ফোন নম্বর সংগ্রহের নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের এই তালিকা করার কাজ চলছে বলে প্রথম আলোকে ডিএমপির একাধিক থানার ওসি জানিয়েছেন। ডিএমপির কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এটা তাঁদের রুটিন ওয়ার্ক বা নিয়মিত কাজ। তাঁরা এ ধরনের তথ্য সব সময় সংগ্রহ করেন।

তবে পুলিশের মাঠপর্যায়ের কোনো কোনো কর্মকর্তার ভাষ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে সহিংস কর্মকাণ্ড ঠেকাতে নেতা–কর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব রাজনৈতিক দলের নির্দিষ্ট অর্থদাতা থাকেন, যাঁরা এসব কর্মসূচিতে অর্থের জোগান দেন। আবার অনেকেই রয়েছেন, যাঁরা টাকা নিয়ে কর্মসূচিতে জনবল সরবরাহ করেন। তাই এঁদের তালিকা বা তথ্য পুলিশের কাছে থাকলে কোথাও কোনো ঘটনা ঘটলে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা যাবে।

এ ছাড়া ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে সারা দেশে বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের নামে যে বিপুলসংখ্যক মামলা হয়েছে, তাতে মৃত ব্যক্তি, কারাগারে বা বিদেশে থাকা নেতা–কর্মীকেও আসামি করা হয়েছিল। যা নিয়ে তখন পুলিশকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তাই হালনাগাদ তালিকা থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি এড়ানো যাবে বলে কর্মকর্তারা মনে করেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, দেশের সব নাগরিকের যখন ডিজিটাল পরিচয়পত্র রয়েছে, তখন এ ধরনের তথ্য সংগ্রহের কোনো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। যদি শুধু সরকারবিরোধীদের তথ্য সংগ্রহ করা হয়, তাহলে মানুষের রাজনৈতিক অধিকারের ওপর হস্তক্ষেপ করা হয়। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটা কাম্য নয়।