কোথাও কোথাও নির্বাচনের ফলাফল ছিল পূর্বনির্ধারিত

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরছবি: সংগৃহীত

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের হার নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদের বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে কোথাও কোথাও নির্বাচন যেভাবেই হোক, ফলাফল পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং ফলাফলের ‘শিট’ বানিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আনা ধন্যবাদ প্রস্তাবের আলোচনা এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সমাপনী ভাষণে জি এম কাদের এসব কথা বলেন। তাঁর বক্তব্যের সময় সরকারি দলের এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা কয়েক দফা হইচই করে প্রতিবাদ জানান।

জি এম কাদের তাঁর বক্তব্যে নির্বাচন, দুর্নীতি, ব্যাংক খাত, বাজার সিন্ডিকেটসহ নানা বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেন। তাঁর বক্তব্যের সময় একাধিকবার সরকারি দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা হইচই করে বাধা সৃষ্টি করেন। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী চেষ্টা করেও তাঁদের পুরোপুরি থামাতে পারেননি। সরকারি দলের সদস্যদের হইচইয়ের জবাবে বেশির ভাগ সময় জি এম কাদেরকে হাসতে দেখা যায়।

জি এম কাদের বলেন, তাঁর মনে হয়েছে তিন ধরনের নির্বাচন হয়েছে। কোনো কোনো এলাকায় নির্বাচন শতভাগ সুষ্ঠু হয়েছে। সেখানে সরকারের সদিচ্ছা ছিল। সাধারণভাবে এখানে প্রতিযোগিতাহীন নির্বাচন হয়েছে। সেখানে কোনো শক্ত প্রার্থী ছিল না। তবে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল। আরেকটা হয়েছে ‘ফ্রি স্টাইল’। সেখানে অর্থ ও পেশিশক্তির অবাধ ব্যবহার করা হয়েছে। সেখানে সরকারি দল, বিদ্রোহী প্রার্থী ও জাতীয় পার্টির শক্ত প্রার্থী ছিল।

জি এম কাদের বলেন, ‘আরেকটা ছিল, যেটা নিয়ে ব্যাপক অভিযোগ আমাদের অনেক নেতা–কর্মী প্রার্থীদের; ইলেকশন যেভাবেই হোক, ফলাফল একটা পূর্বনির্ধারিত ছিল এবং শিট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে।’

সরকারি দলের সদস্যরা ব্যাপকভাবে এই বক্তব্যের প্রতিবাদ জানাতে থাকলে জি এম কাদের হেসে বলেন, এটা না–ও হতে পারে।

ভোটের হার নিয়ে সংশয়

জি এম কাদের বলেন, এবারের সংসদ নির্বাচনে ৪২ শতাংশ ভোট পড়া সম্ভব কি না, তা দেখতে তিনি অঙ্ক করেছেন। যে প্রেক্ষাপটে ছিল, তাতে ৪২ শতাংশ ভোট পড়তে হলে সব ভোটকেন্দ্রের সামনে আট ঘণ্টা লাইন থাকার কথা। কিন্তু তা ছিল না। তাঁর এই বক্তব্যের সময় সংসদ সদস্যরা আবার হইচই শুরু করেন। এরপর তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেছেন, ঘণ্টায় তিন–চারটার বেশি ভোট হয়নি। আমি আমার কথা বলছি না। ধারণার কথা বলছি।’

জি এম কাদেরের এই বক্তব্যের সময় সংসদ সদস্যরা হইচই করতে থাকেন। তখন বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মুজিবুল হককে বলতে শোনা যায়, ‘শুনেন না! ধৈর্য ধরেন।’
পরে জি এম কাদের বলেন, সিংহভাগ মানুষ মনে করেন, ভালো নির্বাচন হয়নি। সঠিকভাবে জনমতের প্রতিফলন হয়েছে বলে সিংহভাগ মানুষ মনে করে না। তিনি মনে করেন, নির্বাচনে আইনকানুন ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে। যাঁদের দেখার কথা, তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে এড়িয়ে গেছেন, অনেক সময় লঙ্ঘনে সহায়তা করেছেন।

জি এম কাদেরের এই বক্তব্যের সময়ও সংসদ সদস্যরা হইচই করতে থাকলে স্পিকার বলেন, ‘মাননীয় সদস্যবৃন্দ, ওনাকে বলতে দিন।’ স্পিকারের অনুরোধের পরও সরকারি দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা হইচই করতে থাকেন। এ সময় কোনো একজন সদস্যকে বলতে শোনা যায়, জামায়াত–বিএনপি, তারেক রহমান বক্তব্য দিচ্ছে আজকে…

অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

আওয়ামী লীগ–বিএনপির একটি দল না এলে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা কঠিন বলে উল্লেখ করেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, সব দল যদি নির্বাচনে আসে এবং বাধাশূন্যভাবে ভোট হয়, সেখানে ১৫ শতাংশ ভোট হলেও তা গ্রহণযোগ্য। তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন, নির্বাচনে জয় হয়েছে জনগণের গণতন্ত্রের। কিন্তু তাঁর জানামতে দেশের বেশির ভাগ মানুষ এ কথার সঙ্গে একমত নন। এই নির্বাচনে শুধু জয়ী হয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। এই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ছাড়া জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে, এমন অন্য সব দল নিজস্ব নীতি ও আদর্শ নিয়ে টিকে থাকতে পারবে কি না, সেটা নিয়ে সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। এখন স্বাভাবিক রাজনীতি একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হচ্ছে।

জি এম কাদের বলেন, রাষ্ট্রপতি বলেছেন যে নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো স্বাধীনভাবে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে পেরেছে। এ বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত নয়। মামলা দিয়ে জেলে বন্দী করা হয়েছে, হুলিয়া দিয়ে ঘরছাড়া করা হয়েছে। রাস্তায় দাঁড়াতে দেওয়া হয়নি। ধানখেতে, বনে, জঙ্গলে তাদের পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। তাদের পক্ষে এমন পরিবেশ ছিল না যে স্বাধীনভাবে কর্মসূচি পালন করতে পারবে।
সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা হইচই করে এ বক্তব্যেরও প্রতিবাদ জানান।

দুর্নীতি ছাড়া কাজ হয় না

রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে দুর্নীতির প্রসঙ্গ আসেনি উল্লেখ করে জি এম কাদের বলেন, দুর্নীতিতে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে। এটা বেশ কিছুদিন ধরে চলছে। দুর্নীতি ছাড়া কোনো কাজ হয় না। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতি সূচকের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ২০০১ সাল থেকে পরপর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। যার প্রথমে ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। (২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকার, এর পর থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ১০ অক্টোবর থেকে ক্ষমতায় ছিল বিএনপি)

এ সময় সরকারি দল ও স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের অনেককে বলতে শোনা যায়, বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। তখন জি এম কাদের বলেন, চারবার হয়েছে বিএনপির আমলে।
টিআইবির তথ্য তুলে ধরে বক্তব্য দেওয়ার সময় সংসদ সদস্যদের কাউকে কাউকে ‘ভুয়া ভুয়া’ বলতে শোনা যায়।

জি এম কাদের বলেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতো কোনো সংগঠন থাকলে সেখানেও বাংলাদেশ ঋণখেলাপির দিকে বিশ্বের ২-১ নম্বরে চলে যেত।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি প্রসঙ্গে জি এম কাদের অভিযোগ করেন, নির্দিষ্ট কিছুসংখ্যক ব্যক্তি পণ্য আমদানি করছেন। এতে সিন্ডিকেট হওয়াটা স্বাভাবিক। এসব ব্যবসায়ী সরকারের নীতিনির্ধারণে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িত। সরকারের কাছে বিকল্প না থাকার কারণে সরকার তাঁদের হাতে জিম্মি বলেও মনে করেন তিনি।