নির্বাচনের আগে ‘জুলাই সনদ’ কার্যকর দেখতে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি

সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নেতারা। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ টাওয়ারেছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

রাষ্ট্র সংস্কারের ‘জুলাই সনদ’ আগামী নির্বাচনের আগেই কার্যকর দেখতে চায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ‘জুলাই ঘোষণাপত্রের’ যে কথা উঠেছিল, দ্রুততম সময়ের মধ্যে সেটিরও বাস্তবায়ন দেখতে চায় তারা। এই দুই দাবির বিষয়টি উল্লেখ করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘বিচার, সংস্কার, পরিবর্তনের কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার)—এগুলোর মধ্য দিয়ে যাতে আমরা নির্বাচনের দিকে যাই।’

আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে জাতীয় নাগরিক কমিটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছে এনসিপি। এর আগে এই কার্যালয়ে এনসিপির প্রথম সাধারণ সভা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে একজন সাংবাদিক প্রশ্ন করেন, প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধান চলতি বছরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছেন। এনসিপি এ বিষয়ে কেন স্পষ্ট বক্তব্য দিচ্ছে না? এর উত্তরে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সময়ের চেয়েও তাঁরা প্রেক্ষাপটের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। ‘জুলাই সনদের’ কথা প্রধান উপদেষ্টা নিজে বলেছেন। সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সনদ তৈরি হবে। যেখানে বাংলাদেশের রূপরেখা কেমন হবে, কী কী সংস্কার এই সময়ে করা হবে, কী কী সংস্কার ভবিষ্যতে করা হবে, কী কী সংস্কারের ধারাবাহিকতা থাকবে—রাজনৈতিক দলগুলোকে সেই কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার) জনগণের কাছে দিতে হবে। সেটাকে জুলাই সনদ বলা হচ্ছে।

পরিবর্তন ও ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ গণ-অভ্যুত্থানে এসেছিল উল্লেখ করে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘এই বিষয়গুলো তো মানুষকে দিতে হবে, পূরণ করতে হবে। তার আগে আমরা কীভাবে নির্বাচনের দিকে যাব? সেই কথাটাই আমরা বলছি। এটা যাতে আমরা ভুলে না যাই। বিচার, সংস্কার, পরিবর্তনের কমিটমেন্ট (অঙ্গীকার)—এগুলোর মধ্য দিয়ে যাতে আমরা নির্বাচনের দিকে যাই।’

গণপরিষদ নির্বাচন ও সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে নাহিদ ইসলাম বলেন, গণপরিষদ নির্বাচন মূলত রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে। যদি সেই ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সময়ের মধ্যেই গণপরিষদ ও জাতীয় সংসদ নির্বাচন একসঙ্গে করা সম্ভব। তবে নির্বাচনে যাওয়ার আগে দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম ও জুলাই সনদের বাস্তবায়ন দেখতে চান তাঁরা।

‘ক্রাউড ফান্ডিং’

গতকাল বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সে নাহিদ ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়। সেখানে নাহিদের বরাত দিয়ে লেখা হয়, বাংলাদেশজুড়ে অনেক ‘সম্পদশালী’ (অ্যাফ্লুয়েন্ট) ব্যক্তি এনসিপিকে অর্থ দিয়ে সহায়তা করছেন। নাহিদ ইসলামকে উদ্ধৃত করে ওই সাক্ষাৎকারে আরও বলা হয়, অন্তর্বর্তী সরকার এখনো পুরোপুরি জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি এবং এ বছর জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করা কঠিন হবে।

এ বিষয়ে আজকের সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, রয়টার্সের সাক্ষাৎকারে কিছু মিসকোট (ভুলভাবে উদ্ধৃত) করা হয়েছে বা ভুল অনুবাদ হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দলের আর্থিক বিষয়ে আমি বলেছিলাম, সমাজের সচ্ছল মানুষ, আমাদের সচ্ছল সদস্য ও শুভাকাঙ্ক্ষী যাঁরা আছেন, তাঁরা মূলত আমাদের সহযোগিতা করেন। আমরা অনলাইন ও অফলাইনে একটা ক্রাউড ফান্ডিংয়ের (গণচাঁদা সংগ্রহ) দিকে যাচ্ছি, যে ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে আমরা দলের কার্যালয় স্থাপনসহ নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করব। আমার এ কথার একটা ভুল অনুবাদ দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে। এটা সংশোধনের জন্য আমাদের অনুরোধ থাকবে।’

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ টাওয়ারে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নাহিদ বলেন, ‘আমি বলেছিলাম, এখন দেশে যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, পুলিশ যে রকম নাজুক অবস্থায় আছে, এ রকম অবস্থায় নির্বাচন করাটা অনেক বেশি কঠিন হবে এবং এই পুলিশ-প্রশাসনের একটা সুষ্ঠু নির্বাচন করার সক্ষমতার পরীক্ষা দীর্ঘদিন ধরে হয়নি। সেই জায়গা থেকে আমি বলেছি, আমাদের অবশ্যই নির্বাচনের আগে দেশের পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাব্যবস্থা অবশ্যই উন্নত করতে হবে। সেটার জন্য সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন সামাজিক শক্তিকেও এগিয়ে এসে সহযোগিতা করতে হবে। নির্বাচনের জন্য এনসিপির মানসিকতা ও প্রস্তুতি রয়েছে।’

কেবল নির্বাচনই এই মুহূর্তে এনসিপির একমাত্র দাবি নয় উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, জাতীয় সংসদের পাশাপাশি গণপরিষদ নির্বাচন দেখতে চান তাঁরা। কিন্তু এর আগে দৃশ্যমান বিচার কার্যক্রম দেখতে চান।

আরও পড়ুন

সমন্বয়ক পরিচয় এখন আর কার্যকর নয়

এনসিপির অর্থায়ন কীভাবে হবে, সে বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে নাহিদ ইসলাম বলেন, আর্থিকভাবে যাঁরা সহযোগিতা করছেন, নাম প্রকাশ করা হলে তাঁরা কোনো ধরনের ক্ষতির শিকার হবেন না, সেই নিশ্চয়তা সরকার থেকে দিতে হবে। সেই সংস্কৃতিটা বাংলাদেশে এখনো তৈরি করা যায়নি। তিনি বলেন, ‘যেসব অলিগার্ক (ক্ষমতাধর গোষ্ঠী) ছিল বাংলাদেশে, যে দুর্নীতিবাজ, লুটেরা ব্যবসায়ী শ্রেণি ছিল, আমরা কখনোই তাদের সমর্থন করি না, করব না। মূলত যারা দেশপ্রেমিক, যারা দেশকে নতুনভাবে গড়তে চায়, ছাত্রদের এই নতুন উদ্যোগকে সমর্থন করছেন, যে সৎ মানুষরা রয়েছেন সমাজে, তাঁদের থেকে আমরা সহযোগিতা চাইছি। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা চাইছি। রিকশাচালক থেকে শুরু করে সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে আমরা আর্থিক সহায়তার জন্য যাব।’

এনসিপি একটি ‘ফিনান্সিয়াল পলিসি টিম’ (আর্থিক নীতি যারা দেখবে) গঠন করেছে বলেও জানান নাহিদ। এ সময় তিনি আরও বলেন, শিগগিরই তাঁরা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করবেন। এনসিপি তারুণ্যনির্ভর দল হলেও উপদেষ্টা পরিষদে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা যুক্ত হবেন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক পরিচয়টি এখন আর সেই অর্থে কার্যকর নয় উল্লেখ করে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অনুরোধ থাকবে, এই পরিচয় ব্যবহার করে কেউ যদি অপকর্ম করে, তারা যাতে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।

সংবাদ সম্মেলনে কথা বলেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম। আজ শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর বাংলামোটরে রূপায়ণ টাওয়ারে
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

নারী নিপীড়নের নিন্দা

সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে নারীর প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এনসিপি নেতা নাহিদ ইসলাম। জনপরিসরে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারকে কঠোর হওয়ার পাশাপাশি নিপীড়নকারীদের দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং এনসিপির নারী সদস্যদের চিহ্নিত করে সাইবার জগতে নানা ধরনের অপপ্রচার ও বুলিং চলছে বলে অভিযোগ করেন নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের সঙ্গে নানাভাবে যারা যুক্ত, তারা এসব কার্যক্রমে অনেক বেশি যুক্ত হচ্ছেন। নারীরা যাতে রাজনীতিতে ও দেশ গঠনের কাজে যুক্ত হতে না পারেন, সে জন্য তাঁদের টার্গেট করা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সরকারের জায়গা থেকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।

বিচারের বিষয়ে সরকারকে চাপ দেওয়া

শেখ হাসিনার বিচার ছাড়া কেউ নির্বাচনের কথা মুখে আনবেন না—এনসিপির মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলমের সাম্প্রতিক এই মন্তব্য দলেরও অবস্থান কি না, এমন প্রশ্ন করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এর জবাবে সারজিস বলেন, তিনি মূলত বিচারের বিষয়ে সামগ্রিকভাবে সরকারকে চাপ দেওয়া এবং এটার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে কথাটি বলেছিলেন। তাঁর ওই বক্তব্যের সঙ্গে সরাসরি নির্বাচন পিছিয়ে যাওয়ার যে সম্পর্ক দেখানো হচ্ছে, এটি কখনো সেভাবে সম্পর্কিত নয়।

আত্মপ্রকাশের এক সপ্তাহের মধ্যে এনসিপি থেকে তিনজন নেতার পদত্যাগ নিয়েও প্রশ্ন করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এ প্রশ্নের উত্তরে এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেন, গণ–অধিকার পরিষদ থেকে এনসিপিতে যোগ দেওয়া তিনজন পদত্যাগ করে আগের দলে ফিরে গেছেন। রাজনৈতিক অসততা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি না করতে সবার প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব নাহিদা সারওয়ার নিভা, মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

এই সংবাদ সম্মেলনের আগে এনসিপির প্রথম সাধারণ সভায় দলের কিছু কর্মসূচি ঠিক করা হয়। পরে বিষয়টি সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন। তিনি জানান, জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ পরিবার ও আহতদের নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ১০ মার্চ ইফতার মাহফিল করা হবে। আর ১১ মার্চ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, ব্যবসায়ী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য এনসিপির পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন করা হবে।