যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের মধ্যে জটিলতা কাটছে না

সরকারের পদত্যাগ সহ ১৪ দফা দাবিতে গণতন্ত্র মঞ্চ সমাবেশ করে গত ১২মে
ফাইল ছবি

যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে একটি ‘যৌথ ঘোষণাপত্র’ চূড়ান্ত করতে কয়েক মাস ধরে চেষ্টা করছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ। দুই পক্ষই দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করার বিষয়ে নীতিগতভাবে একমত। তবে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য এই ঘোষণাপত্র নিয়ে আরও আলাপ-আলোচনার বিষয়ে মত দিয়েছেন। ফলে, কবে নাগাদ এটি চূড়ান্ত হবে, তা নিশ্চিত নয়।

গত ৩০ ডিসেম্বর গণমিছিলের কর্মসূচি দিয়ে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী বিভিন্ন দল ও জোট যুগপৎ কর্মসূচি পালন শুরু করে। প্রথম কর্মসূচির আগেই বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করতে চেয়েছিল গণতন্ত্র মঞ্চ। সেটি না হওয়ায় দ্রুততম সময়ের মধ্যে তা করতে চেয়েও পারা যায়নি। মূলত, বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সিদ্ধান্ত না জানানোয় দীর্ঘ সময় চলে গেছে।

এরই মধ্যে এককভাবে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়ার ব্যাপারে আপত্তি তোলে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য শরিকেরা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে থাকা সব দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা করে এই ঘোষণাপত্র দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি।

গত ৯ মে রাতে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে আলোচনা করেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। বিএনপি সূত্রে জানা যায়, ঘোষণাপত্র প্রণয়ন নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আরও আলোচনা হওয়া দরকার বলে মত দেন দলটির স্থায়ী কমিটির একাধিক নেতা।

ঘোষণাপত্র নিয়ে জটিলতা কোথায়
যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপি ১০ দফা এবং রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কারের ব্যাপারে ২৭ দফা প্রস্তাব করেছে।

বিএনপির জ্যেষ্ঠ এক নেতা জানিয়েছেন, ৯ মে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে একাধিক নেতা বিএনপির এই দাবি-দফা অক্ষুণ্ন রেখে গণতন্ত্র মঞ্চের দাবিগুলো সমন্বয় করার পক্ষে মত দেন। তাঁদের মতে, বিএনপি তাদের দাবি-দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে প্রচার চালাচ্ছে। তাতে কোনো পরিবর্তন আনা হলে সেটা নেতিবাচক হতে পারে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যৌথ ঘোষণাপত্রের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দলের অভ্যন্তরের এই আলোচনা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে সেটা দলের পক্ষ থেকেই জানানো হবে।’

তবে গণতন্ত্র মঞ্চের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, বিএনপির ১০ দফা এবং সংস্কারের ব্যাপারে ২৭ দফা প্রস্তাব রয়েছে। আর গণতন্ত্র মঞ্চ দাবি এবং সংস্কারের রাজনৈতিক কর্মসূচি মিলিয়ে দিয়েছে ১৪ দফা। এখনো প্রস্তাবগুলো সমন্বয় করে ঘোষণাপত্র তৈরির কাজ চলছে।

আন্দোলনরত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সমন্বয় করতে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করেছে বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ কমিটির বৈঠকে ঘোষণাপত্রের খসড়াও দেওয়া হয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চের দেওয়া খসড়া ঘোষণাপত্রের অধিকাংশ বিষয়ের সঙ্গে লিয়াজোঁ কমিটিতে থাকা বিএনপির সদস্যরা একমত হওয়ার পরও দীর্ঘ সময়ে দলটি তাদের সিদ্ধান্ত জানায়নি। গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, যৌথ ঘোষণাপত্র জনগণের কাছে আন্দোলনে থাকা দলগুলোর রাজনৈতিক অঙ্গীকার। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এটি চূড়ান্ত করে জনসমক্ষে আনা প্রয়োজন বলে তাঁরা মনে করেন।

যা বলছেন নেতারা
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম নেতা গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি নিজেদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতেই পারে। তবে যৌথ ঘোষণাপত্র দেওয়ার বিষয়ে বিএনপি নীতিগতভাবে একমত আছে বলে জানিয়েছে। কোনো কারণে যৌথ ঘোষণাপত্র বাধাগ্রস্ত হলে তা চলমান আন্দোলনের জন্য ইতিবাচক হবে না। এমন কিছু হলে জনগণ হতাশ হবে।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপির নেতৃত্বে যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নিচ্ছে একাধিক দল ও জোট। গণতন্ত্র মঞ্চ ছাড়াও রয়েছে ১২-দলীয় জোট ও ১১ দলের জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট। এর বাইরে এলডিপি ও গণফোরাম (মন্টু) নিজেদের মতো করে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করছে। ৬ মে সাত দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেছে গণ অধিকার পরিষদ। জোট থেকে বেরিয়ে গেলেও বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনে দলগতভাবে থাকার কথা জানিয়েছে গণ অধিকার পরিষদ।

আন্দোলনে থাকা শরিক সব দল ও জোটকে নিয়েই যৌথ ঘোষণাপত্র দিতে চায় বিএনপি। আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার আগেই ঘোষণাপত্রের প্রয়োজন রয়েছে বলে বিএনপির শরিকেরা মনে করেন।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক প্রথম আলোকে বলেন, যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে বিএনপির সঙ্গে বড় কোনো দ্বিমত নেই। ভিন্নমত থাকলে সেটি নিয়েও আলোচনার সুযোগ আছে। গণতন্ত্র মঞ্চ যেমন তাদের ১৪ দফায় সম্মত হতে বিএনপিকে বলবে না, বিএনপিও তাদের ২৭ দফায় সম্মত হতে বলবে না। কিন্তু দ্রুততম সময়ে যৌথ ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা সম্ভব না হলে আন্দোলনে এর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

বিএনপির নেতারা অবশ্য বলছেন, যৌথ ঘোষণাপত্র নিয়ে আলোচনা করতে বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটি আবারও গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বৈঠকে বসবে। তবে অল্প সময়ের মধ্যে ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে, সে ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছেন না গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা।