রওশনকে ‘সতর্ক’ করবে জাপা

রওশন এরশাদফাইল ছবি

সম্মেলন ডেকে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে সাদ এরশাদকে ‘সতর্ক’ করবে জাতীয় পার্টি (জাপা)। এরপরও নিবৃত্ত না হলে দুজনের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া দলের সাবেক মহাসচিব মসিউর রহমানকে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চিফ হুইপের পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপা। এমনকি দলে তাঁর প্রাথমিক সদস্যপদও আর থাকছে না।

জাপার প্রেসিডিয়াম (সভাপতিমণ্ডলী) ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। গতকাল শনিবার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঢাকার বনানীতে জাপা চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে রুদ্ধদ্বার ওই সভা হয়।

সভায় অংশ নেওয়া জাপার প্রেসিডিয়ামের চারজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গতকালের সভায় অন্যতম আলোচ্য বিষয় ছিল রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে রাহগির আল মাহীর (সাদ এরশাদ) প্রসঙ্গে। জাপার দশম সম্মেলনের নামে রওশন এরশাদকে ঘিরে কিছু সাবেক নেতার সাম্প্রতিক তৎপরতার বিষয়টি আলোচনা তোলেন একাধিক সদস্য।

আরও পড়ুন

তাঁরা বলেন, সম্মেলন নিয়ে রওশন এরশাদ ভিডিও বার্তা দেওয়ার পর, এটি পরিষ্কার হয়ে গেছে ‘ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়’ হোক তিনিও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ বিষয়ে এখনই শক্ত পদক্ষেপ না নিলে দলে বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা আরও বাড়বে। চুপচাপ থাকলে মাঠপর্যায়ে এই বার্তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে যে জাতীয় পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।

তবে রওশন ও সাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে তাঁদের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী, সালমা ইসলাম, মোস্তফা আল মাহমুদসহ কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্য। এর মধ্যে মাসুদ উদ্দিন ও সালমা ইসলাম জাপার সংসদ সদস্যও। সভার একপর্যায়ে রওশন এরশাদকে ‘মামি’ সম্বোধন করে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার আগে কথার পক্ষে মত দেন জাপার আরেক সংসদ সদস্য আহসান আদিলুর রহমান।

পরে সিদ্ধান্ত হয় রওশন ও সাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আদিলুর রহমান কথা বলবেন। আদিলুর এরশাদের বোনের ছেলে এবং দলের যুগ্ম মহাসচিব। সিদ্ধান্ত হয়, আগামী ২৬ নভেম্বর আহ্বান করা সম্মেলনের তৎপরতা থেকে রওশন ও সাদকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করা হবে। এর পরও তাঁরা যদি এই তৎপরতা থেকে সরে না দাঁড়ান, তাহলে রওশন এরশাদকে জাপার ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’-এর পদ থেকে এবং সাদ এরশাদকে ‘যুগ্ম মহাসচিব’–এর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। উল্লেখ্য, সাদ রংপুর সদর আসনে জাপার সংসদ সদস্য।

আরও পড়ুন

জাপার একাধিক সূত্র বলছে, দলের সিনিয়র কো–চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সভায় বলেছেন তিনি বিষয়টি নিয়ে রওশন এরশাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁকে ‘মাতৃসম’ উল্লেখ করে চলমান তৎপরতা থেকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি কোনো কিছু শুনতে চাচ্ছেন না। ইতিমধ্যে ভিডিও কনফারেন্স করেছেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ইভিএমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সুতরাং এসব বিষয়ে সময়মতো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

জাপা সূত্র জানায়, সভায় আনিসুল ইসলাম মাহমুদ দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেছেন, জি এম কাদের রক্তের উত্তরাধিকার হিসেবে চেয়ারম্যান হননি। যোগ্যতার ভিত্তিতে হয়েছেন এবং তিনি ইতিমধ্যে তাঁর যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন। এখন মানুষ জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের ‘দালাল’ মনে করে না।

সতর্কবার্তা

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদ সদস্য মিলে গতকালের সভায় অংশ নেন ৩৮ জন। এর মধ্যে ২০ জন সংসদ সদস্য ও ১৮ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য। দলের ৪১ সদস্যের সভাপতিমণ্ডলীতে সংসদ সদস্য ২৪ জন। এর মধ্যে রওশন এরশাদ, সাদ এরশাদ, সেলিম ওসমান ও পীর ফজলুর রহমান সভায় ছিলেন না। চারজনই দেশের বাইরে আছেন। সভায় সংসদ সদস্য মসিউর রহমানকে রাখা হয়নি।

সভায় উপস্থিত একাধিক সূত্র জানায়, রওশন এরশাদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ‘সতর্ক’ বার্তা দেওয়ার কথা বলেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। সেনাজীবনের অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। ‘অ্যাটাক’ ডানে হোক বাঁয়ে হোক, আগানো–পেছানো যাবে না।

জানা গেছে, সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য সভায় বলেছেন, তাঁর কাছে তথ্য আছে, ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদকে অনেকটা জিম্মি করে রেখেছেন সাদ এরশাদ। অনেক নেতা ফোন করে রওশনকে পান না। সাদের আস্থাভাজন ছাড়া কাউকে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হচ্ছে না।

জাপার একাধিক দায়িত্বশীল নেতা জানান, রওশন ও সাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আগে ‘কথা বলার’ নীতিগত সিদ্ধান্ত হলেও মসিউর রহমানকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেওয়ার সিদ্ধান্তে কারও ভিন্নমত ছিল না। এর আগে গত ১৪ সেপ্টেম্বর মসিউরকে সভপতিমণ্ডলীর সদস্যসহ দলের সব পদ-পদবি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। তিনি রওশনকে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে জাপার চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জি এম কাদেরকে স্থলাভিষিক্ত করার সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত থেকেও পরে ভিন্ন অবস্থান নেন। এর জের ধরে তাঁকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

যদিও রওশন এরশাদকে সরিয়ে জি এম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা করতে জাপার সংসদীয় দলের সিদ্ধান্ত এখনো কার্যকর হয়নি। বিষয়টি স্পিকারের কাছে আটকে আছে।

গতকালের সভায় বিষয়টি আলোচনায় তোলেন মোস্তফা আল মাহমুদ। তিনি বলেন, স্পিকার কী পদক্ষেপ নেন, সেটি দলের জন্য একটি বার্তা হবে।

সভা শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে জাপার মহাসচিব মুজিবুল হক সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, জি এম কাদেরই বিরোধীদলীয় নেতা। জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা তাঁর নেতৃত্বেই সংসদে যাবেন। নৈতিকতার প্রশ্নেই দেশে ফিরে রওশন এরশাদের বিরোধীদলীয় নেতার পতাকা ব্যবহার করা উচিত নয়। আর মসিউর রহমান নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি করবেন না। তাই তাঁর বিরোধীদলীয় হুইপের পদে থাকার প্রশ্নই আসে না।

ব্যাংককে চিকিৎসাধীন রওশন এরশাদ গত ৩০ আগস্ট হঠাৎই গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ২৬ নভেম্বর জাতীয় পার্টির সম্মেলন আহ্বান করে একটি প্রস্তুতি কমিটি ঘোষণা করেন। এরপর রওশনের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসীহসহ দলের কিছু বহিষ্কৃত, অব্যাহতি পাওয়া এবং দলীয় পদ হারানো নেতা তৎপর হন। এ নিয়ে দলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।

এ বিষয়ে দলের কো–চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার গতকাল সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেন, বিগত সম্মেলনেই জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানকে দল পরিচালনার সব ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি ঐক্যবদ্ধ আছে, দলে কোনো বিভেদ নেই।