আমার নামে ৯৮ মামলা, আর দুটি হলে সেঞ্চুরি হবে: মির্জা ফখরুল

‘বিচার বিভাগের বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশে বিরোধীদের দমনের হাতিয়ার’ শীর্ষক সেমিনারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ অন্য অতিথিরা
ছবি: প্রথম আলো

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘বিরোধী রাজনীতি করেন, এমন প্রায় ৪০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা। প্রতিদিন নিম্ন আদালতে যেতে হচ্ছে। আমার নামে ৯৮টি মামলা। আর দুটি হলে সেঞ্চুরি হবে। সব বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। আদালতে হাজিরার কারণে সকালের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আসতে পারেন না।’

আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশে বিরোধীদের দমনের হাতিয়ার’ শীর্ষক সেমিনারে মির্জা ফখরুল ইসলাম এসব কথা বলেন। সেমিনারের আয়োজন করে ইউনাইটেড লইয়ার্স ফ্রন্ট (ইউএলএফ)। চলমান সরকারিবিরোধী আন্দোলনে থাকা বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলোর সমর্থক আইনজীবীদের নতুন মোর্চা ইউএলএফ।

বিচারব্যবস্থার পুরোপুরি দলীয়করণ হয়েছে বলে অনুষ্ঠানে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল। তিনি বলেছেন, বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা ছিল। এখন বিরোধীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে বিচার বিভাগকে। বিচারব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।

বিচারব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে দাবি করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, উচ্চ আদালতের প্রতি মানুষের আস্থা, শ্রদ্ধা কেমন আছে? সেটি বড় বিষয়। পুলিশ, বিচারক রাজনৈতিক নেতাদের মতো কথা বলেন। তখন সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? যদি বিচারব্যবস্থার পুরোপুরি দলীয়করণ হয়ে যায়, মানুষ কোথায় যাবে?

গত মঙ্গলবার ঢাকার জজ কোর্ট এলাকায় বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের পুলিশ লাঠিপেটা করে। এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, আইনজীবীরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মার খাবেন, এটি চিন্তাও করতে পারি না। ঢাকা বারের সামনে পুলিশ হামলা করে আইনজীবীদের আহত করেছে। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। দেখলাম, এ ঘটনায় ৬৬ জন আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। তারাই মারল, আবার যাঁরা মার খেলেন, তাঁদের বিরুদ্ধেই মামলা দিল। পুরো বাংলাদেশে এখন এটাই চলছে।

বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের তীব্র আপত্তির মুখে গতকাল বুধবার ‘সাইবার নিরাপত্তা বিল’ জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এর আগে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট ছিল। যেটা নিয়ে সাংবাদিক, সুশীল সমাজ, রাজনীতিবিদেরা প্রতিবাদ জানিয়েছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাও আইনের ধারা পরিবর্তন করতে বলেছিল। কিন্তু কিছুই পরিবর্তন না করে, শুধু নাম পরিবর্তন করে সরকার সাইবার সিকিউরিটি বিল পাস করেছে। এ ঘটনার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।’

নীরবে দেশের গণতন্ত্র হত্যা করা হয়েছে দাবি করে মির্জা ফখরুল বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্যে দিয়ে অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চয়তা ও সহিংসতার রাজনীতি শুরু হয়েছে। প্রতিটি জায়গায় সরকার তাদের জবরদখল প্রতিষ্ঠা করেছে। বাকশাল নামটা বাদ দিয়ে দেশ আবার একই পরিস্থিতিতে চলে এসেছে। মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে এই সরকারকে আর দেখতে চায় না। রাষ্ট্র সংস্কারে ঘোষিত ৩১ দফা অনুযায়ী, বিচারব্যবস্থার বিষয়ে যেসব সমস্যা রয়েছে, সেগুলো চিহ্নিত করতে জুডিশিয়াল পাবলিক কমিশন করা হবে।

বিচার বিভাগ ‘অদৃশ্য ইঙ্গিতের’ অপেক্ষায়
সেমিনারে সাবেক দুই বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী ও মিফতাহ উদ্দীন চৌধুরী বক্তব্য দেন। নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বিচার বিভাগের ভিত্তি জনগণের বিশ্বাস। একবার জনগণের বিশ্বাস সরে গেলে, সেই কাঠামো আর টিকতে পারে না। বিচারকেরা হলেন ঐশ্বরিক আত্মা। সেখান থেকে আমরা কই নেমেছি। সুপ্রিম কোর্ট ধ্বংস হলে জাতি ধ্বংস হয়ে যাবে।’

‘অদৃশ্য ইঙ্গিতে’ ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় পরিবর্তন হয়েছিল অভিযোগ করে বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বিচার বিভাগের অনেকেই এখন অদৃশ্য ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকেন। কেন ইঙ্গিতের অপেক্ষায় থাকবেন? ইঙ্গিত পেলেও শুনবেন কেন? শোনেন কারণ, এতে ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ করার সুযোগ হয়। অদৃশ্য ইঙ্গিত এমনভাবে কাজ করে, বিচারকদের হাত পঙ্গু হয়ে যায়। এই দুঃখ কার কাছে বলব।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার বিদায় প্রসঙ্গ তুলে মিফতাহ উদ্দীন বলেন, ‘উনাকে যেভাবে বিদায় করা হয়েছে, সারা বিশ্বে কোনো বিচারপতিকে এভাবে বিদায় করা হয়নি। সাবেক প্রধান বিচারপতির রায় নিয়ে ফজলে নূর তাপস যে বক্তব্য দিয়েছেন, এরপরেও বিচার বিভাগ নীরব। এগুলো দেখলে নিজের বিবেক বড় কষ্ট দেয়। অধঃপতন শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর থেকে।’

সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের দেওয়া সংবিধানে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের রায় প্রসঙ্গে মিফতাহ উদ্দীন চৌধুরী বলেন, ‘উনি ওপেন কোর্টে এক রায় দিলেন। কয়েক মাস পর অন্য রায় লিখলেন।’ তিনি বলেন, সর্বোচ্চ আদালত ন্যায়ের ভিত্তিতে বিচার না করলে গণতন্ত্র রক্ষা করা যাবে না। বিচার বিভাগ সুস্থ না থাকলে দেশ-গণতন্ত্র কিছুই সুস্থ হবে না, ভালো থাকবে না।

সরকার বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণে এনেছে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক বোরহান উদ্দিন খান বলেন, সরকার, ক্ষমতাসীন দল, বিচার বিভাগ ও রাষ্ট্রের ভিন্নতাগুলো এক হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সরকার বিচার বিভাগকে ব্যাপকভাবে নিয়ন্ত্রণে এনেছে। কিছু ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ অতি উৎসাহী হয়ে নিজেরাই সরকারের অনেক উদ্দেশ্য সাধন করছে। যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, তারেক রহমানের বক্তব্য প্রচার, সর্বস্তরে জয় বাংলা বাধ্যতামূলক, রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল, স্বাধীনতার ঘোষক কাকে বলা যাবে, কাকে বলা যাবে না।    

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বিচার বিভাগের নিম্নগামী যাত্রা শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করার পর থেকে। বিচারকেরা রাজনীতিবিদ-ইতিহাসবিদদের দায়িত্ব পালন করছেন। যেগুলো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা, সেগুলোও বিচার বিভাগ করছে। বিচার বিভাগের যে দায়িত্ব সংবিধান ও আইনকে রক্ষা করা, সেটি তারা ভালোভাবে করছে না।’

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ইউএলএফের যুগ্ম আহ্বায়ক সুব্রত চৌধুরী। সভাপতিত্ব করেন ইউএলএফের আহ্বায়ক ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন। ইউএলএফের প্রধান সমন্বয়ক ও বিএনপির আইন সম্পাদক কায়সার কামাল অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মহসিন রশীদ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সদস্য রুহুল কুদ্দুস প্রমুখ।