লক্ষ্য আন্দোলন মোকাবিলা ও নির্বাচন

আজ শনিবার সকাল ১০টায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুরু হচ্ছে আওয়ামী লীগের ২২তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন।

ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রস্তুত। আজ এখানেই আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন বসছে। ক্ষমতাসীন দলের নতুন নেতৃত্ব নির্বাচনের আয়োজনে মুখর হবে এই উদ্যান। গতকাল সকালে সম্মেলন মঞ্চের সামনে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি
ছবি: শুভ্র কান্তি দাশ

আওয়ামী লীগের সর্বশেষ যে দুটি জাতীয় সম্মেলন হয়েছে, সে সময়টায় দেশের রাজনীতির মাঠ ছিল অনেকটাই শান্ত বা স্থিতিশীল। তখনকার নতুন কমিটিকে দায়িত্ব নিয়েই ভোটের মাঠে দৌড়াতে হয়নি। মোকাবিলা করতে হয়নি বিরোধী দলের আন্দোলন-কর্মসূচি। সেদিক থেকে এবারের সম্মেলনটা হচ্ছে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। এক বছর পরই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এরই মধ্যে নির্বাচনমুখী রাজনীতি শুরু হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন পর বিরোধী দলও কর্মসূচি নিয়ে মাঠে সক্রিয়।

এমন একটা অবস্থার মধ্যে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ২২তম সম্মেলন হতে যাচ্ছে আজ। এর মধ্য দিয়ে গঠিত কমিটিকে দৌড়াতে হবে নির্বাচনের পথে। একই সঙ্গে বিরোধী দলের আন্দোলনও মোকাবিলা করতে হবে। ফলে নির্বাচন ও আন্দোলন মোকাবিলার লক্ষ্য সামনে রেখেই এবারের সম্মেলন করছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন ও আন্দোলন মাথায় রেখেই বিভিন্ন সময়ে বহিষ্কৃত তৃণমূলের নেতাদের সম্মেলনের আগ দিয়ে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আজ শনিবার সকাল ১০টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেশের ঐতিহ্যবাহী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ২২তম ত্রিবার্ষিক সম্মেলন শুরু হচ্ছে। এর মধ্যে নতুন গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। ঘোষণাপত্রে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহার কেমন হতে পারে, এর একটা ধারণা দেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণাপত্র প্রণয়নে যুক্ত সূত্র জানিয়েছে।

এবারের সম্মেলনে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রত্যয় তুলে ধরা হবে। সম্মেলনের স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘উন্নয়ন অভিযাত্রায় দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়’।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, সম্মেলনে দলের সভাপতি শেখ হাসিনা সারা দেশ থেকে আসা নেতা, কাউন্সিলর ও প্রতিনিধিদের আগামী নির্বাচন নিয়ে দিকনির্দেশনা দেবেন। গত ১৪ বছর সরকার কী করেছে, সামনে জয়ী হলে কী করা হবে—এসব বিষয় থাকবে। তিনি জানান, বিরোধী দলের আন্দোলন ও নির্বাচন বিবেচনায় নিয়েই এবারের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে।

আরও পড়ুন

অনুষ্ঠানসূচি অনুসারে, সকাল ১০টায় জাতীয় সংগীতের সঙ্গে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়ে সম্মেলন শুরু হবে। জাতীয় পতাকা উত্তোলন করবেন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দলীয় পতাকা উত্তোলন করবেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ সময় ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকেরা তাঁদের জন্য নির্ধারিত স্থানে দাঁড়িয়ে দলীয় পতাকা উত্তোলন করবেন। শান্তির প্রতীক পায়রা ও বেলুন উড়িয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন শেখ হাসিনা। এরপর কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের নেতারা মঞ্চে বসবেন। মঞ্চে ১২০ জনের বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

নেতারা মঞ্চে বসার পর কোরআন তিলাওয়াতসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করা হবে। এরপর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। শোকপ্রস্তাব উত্থাপন করবেন দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া। সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদন উপস্থাপন করবেন ওবায়দুল কাদের। স্বাগত বক্তব্য দেবেন অভ্যর্থনা কমিটির আহ্বায়ক শেখ ফজলুল করিম সেলিম। সভাপতি শেখ হাসিনার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শেষ হবে।

এবারের জাতীয় সম্মেলনে সারা দেশ থেকে প্রায় ২১ হাজার কাউন্সিলর ও প্রতিনিধি অংশ নেবেন। আমন্ত্রিত অতিথি মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও ঢাকায় অবস্থিত বিদেশি দূতাবাসের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।

বেলা তিনটায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন প্রাঙ্গণে বসবে কাউন্সিল অধিবেশন। শুরুতে বর্তমান নির্বাহী কমিটির মুলতবি বৈঠক। এরপর নেতৃত্ব নির্বাচনের জন্য দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইউসুফ হোসেন হ‌ুমায়ূনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন মঞ্চে আসবে। কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা মঞ্চ থেকে নেমে সামনের আসনে বসবেন। এরপর শুরু হবে নেতা নির্বাচন। সাধারণত আওয়ামী লীগের নেতা নির্বাচিত হয় আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে। এবারও সেভাবেই হবে বলে দলের নেতারা মনে করছেন।

সম্মেলন সফল করতে ১১টি উপকমিটি কাজ করছে। দাওয়াতপত্র বিতরণ, গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র সংশোধন, মঞ্চ ও সাজসজ্জাসহ আনুষঙ্গিক সব কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে।

ভাসানী থেকে শেখ হাসিনা

আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সম্মেলন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের জন্মের পর ৭৩ বছর পেরিয়েছে। এর মধ্যে বর্তমান সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দশকের বেশি সময় দলের হাল ধরে আছেন। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের জন্মের পর এর অর্ধেকের বেশি সময় ধরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। ১৯৮১ সাল থেকে তিনি টানা নয়বার সম্মেলনের মাধ্যমে দলের সভাপতি হয়েছেন। দলের প্রায় সব নেতা তাঁকে আজীবন এ পদে দেখতে চান—এটা প্রকাশ্যেই বলে থাকেন।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ প্রথিতযশা নেতারা এই দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এর মধ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী তিনবার করে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার পর টানা তিনবার সাধারণ সম্পাদক হন শুধু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওবায়দুল কাদের আজ পুনরায় সাধারণ সম্পাদক হলে তিনি দ্বিতীয় ব্যক্তি হিসেবে এ পদে হ্যাটট্রিক করবেন।

আওয়ামী লীগের সবচেয়ে লম্বা সময় সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দুবার ও তাঁরই কন্যা আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দুবার। চার দফায় ১৬ বছর সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। দ্বিতীয় লম্বা সময় সাধারণ সম্পাদক দায়িত্ব পালন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি চার মেয়াদে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এরপর দুই দফায় ১০ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন প্রয়াত সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। ভারপ্রাপ্ত ও নির্বাচিত মিলিয়ে আট বছর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম।

গত তিন বছরে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৬৮টিতে সম্মেলন হয়েছে। এসব কমিটির বেশির ভাগই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে পুরোনোদের রেখে দেওয়া হয়েছে। ওবায়দুল কাদের গত বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, নতুন কমিটিতে তেমন একটা পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই। প্রয়োজনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আরেকটি আগাম সম্মেলনও হতে পারে।

প্রয়াতদের শূন্যস্থান পূরণ

এক সম্মেলন থেকে আরেক সম্মেলন বিবেচনায় নিলে সাম্প্রতিক সময়ে বর্তমান কমিটির আমলে কেন্দ্রীয় ও জ্যেষ্ঠ নেতাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়াত হয়েছেন। করোনা মহামারির সময়কালে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের ১৫ জনের মতো নেতা মারা গেছেন। তৃণমূল হিসাবে আনলে গত তিন বছরে দলের পদধারী দেড় শর মতো নেতা মারা গেছেন। আগামী এক বছরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। প্রয়াত নেতাদের শূন্যস্থান পূরণের বিষয়টি বিবেচনায় আছে।

২০১৯ সালে সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনের পর দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, সাহারা খাতুন ও আবদুল মতিন খসরু প্রয়াত হয়েছেন। আবদুল মান্নান দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। এর মধ্যে রাজশাহীর মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান (লিটন), মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী (মায়া), কামরুল ইসলাম এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। নতুন কমিটিতে তাঁরা পুনরায় স্থান পাবেন বলেই মনে করছেন দলের নেতারা। তবে সভাপতিমণ্ডলীর পুরোনো সদস্যদের মধ্যে কাউকে কাউকে উপদেষ্টা পরিষদে পাঠিয়ে নতুন কাউকে নেওয়া হতে পারে—এমন আলোচনাও আছে।

কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর ৩৪ জনের প্রায় সবাই আছেন। তাঁদের কেউ কেউ এক যুগ বা এরও বেশি সময় ধরে দায়িত্বে। এবার মূল পরিবর্তন সম্পাদকমণ্ডলীতেই আসতে পারে বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা। এ ক্ষেত্রে কেউ বাদ পড়বেন, নতুন যুক্ত হবেন, কারও পদোন্নতির সম্ভাবনা রয়েছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ২৮ জন। এর মধ্যে দুজন সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পেয়েছেন, দুজন মারা গেছেন। অর্থাৎ শূন্য পদ চারটি। আরও কিছু সদস্য বাদ পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে সম্পাদকমণ্ডলী থেকে বাদ পড়া এবং সাবেক ছাত্রনেতারা নির্বাহী কমিটিতে অগ্রাধিকার পেতে পারেন।

আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সর্বনিম্ন সদস্য ৫১ জন। সভাপতি চাইলে সংখ্যা বাড়াতে পারেন। বর্তমানে আছেন ৩৮ জন। ফলে উপদেষ্টা পরিষদে জ্যেষ্ঠ নেতাদের আরও অনেকেরই ঢোকার সুযোগ আছে।

আওয়ামী লীগের জন্ম ও পথচলা

১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেনে কর্মী সম্মেলনের মাধ্যমে জন্ম নেয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। জন্মের পর থেকে ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা অর্জনসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও অর্জনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আওয়ামী লীগের নাম।

১৯৫৫ সালের তৃতীয় জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে সব ধর্ম, বর্ণের প্রতিনিধি হিসেবে দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এরপর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ—এই ধাপগুলো পেরিয়ে ১৯৭৬ সালে পুনরায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ নামে পুনর্বহাল হয়। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা, সামরিক শাসন, পুনরায় ২১ বছর পর রাষ্ট্রক্ষমতায় আরোহণ—নানা চড়াই-উতরাই পার করেছে দলটি। ১৪ বছর ধরে টানা ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ।