মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার শপথ ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা যোদ্ধাদের

ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ শনিবার একাত্তরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর মিলনমেলায় অংশগ্রহণকারী বীর মুক্তিযোদ্ধারাছবি: প্রথম আলো

বিজয়ের মাস ঢাকায় এক হলেন একাত্তরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধারা; তাঁরা শপথ নিলেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা রক্ষার।

আজ শনিবার ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গেরিলা যোদ্ধাদের এই মিলনমেলায় এই বাহিনীর জীবিত সদস্যদের পাশাপাশি শহীদ পরিবারের সদস্যরা অংশ নেন। দিনভর এই আয়োজন করে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন বিশেষ গেরিলা বাহিনী সমন্বয় কমিটি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে আলাদা গেরিলা বাহিনী গঠন করে অংশ নিয়েছিলেন ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যরা। কয়েক হাজার গেরিলা যোদ্ধার এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ। কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের বেতিয়ারার যুদ্ধে এই বাহিনীর সদস্যদের আত্মদান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আলোচিত ঘটনা।

স্বাধীনতার পর এই গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা মোহাম্মদ ফরহাদের নেতৃত্বে অস্ত্র সমর্পণ করেছিলেন। দেড় যুগ আগে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর মুক্তিযোদ্ধাদের যে তালিকা করেছিল, তাতে এই বাহিনীর সদস্যদের রাখা হয়নি। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

শহীদ মিনারে মিলনমেলার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম। তিনি এই গেরিলা বাহিনীর সদস্য ছিলেন, স্বাধীনতার পর অনুষ্ঠিত প্রথম ডাকসু নির্বাচনে ভিপি হয়েছিলেন তিনি।

ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ শনিবার একাত্তরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর মিলনমেলায় সিপিবির সাবেক সভাপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম
ছবি: প্রথম আলো

ঘোষণাপত্রে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হতে চলেছে। ঐতিহাসিক সেই সময়ের জনযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সেনা-মুক্তিবাহিনীর একক সাফল্য ছিল না; এটি ছিল সর্বজনীন জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ, ত্যাগ ও আত্মত্যাগে গড়ে ওঠা সশস্ত্র রাজনৈতিক সংগ্রাম।

গণমানুষের ত্যাগ এবং নেতা ও দলের সমন্বিত নেতৃত্বকেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মূল চালিকা শক্তি অভিহিত করে মুজাহিদুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো নেতাদের অবদান স্মরণ করেন।

একাত্তরে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারতসহ গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে দাঁড়ানোর কথাও স্মরণ করেন মুজাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাদের কারণেই আমেরিকার সামরিক হস্তক্ষেপের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল।

একাত্তরে বিজয় অর্জনের পরও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্জন পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, বরং বিভিন্ন অপশক্তি এবং রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে ইতিহাস বিকৃত করার চেষ্টা চলছে।

মিলনমেলায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মিজানুর রহমান ১৯৭১ সালের ১১ নভেম্বর বেতিয়ারা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সংঘটিত যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করেন। সেই যুদ্ধে ১১ জন সহযোদ্ধাকে হারানোর কথা বলেন তিনি। যুদ্ধের প্রস্তুতি, অবস্থান ও সংঘর্ষের মুহূর্তগুলোর বর্ণনাও তিনি দেন।

ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আজ শনিবার একাত্তরে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ গেরিলা বাহিনীর মিলনমেলায় মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত সংবাদ ও ছবি নিয়ে প্রদর্শনীর আয়োজনও ছিল
ছবি: প্রথম আলো

মিজানুর রহমান বলেন, এই যুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের সব সংগ্রামই বীর শহীদদের ত্যাগ ও গণমানুষের সাহসিকতার ফল।

মিলনমেলায় অংশ নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা সমস্বরে অঙ্গীকার করেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে ধ্বংস হতে দেব না, শহীদদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না এবং ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়াব।’

তাঁরা নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস ও চেতনায় সংগঠিত করার প্রত্যয় প্রকাশ করেন।

ঘোষণাপত্রে বলা হয়, মিলনমেলার আয়োজনের উদ্দেশ্য কেবল স্মৃতিচারণা নয়; এটি গণতান্ত্রিক ও শোষণমুক্তির সংগ্রামের নব সূচনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও চেতনার আলোকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সংহত করার বার্তাও দেওয়া হয় ঘোষণাপত্রে।

মিলনমেলার আয়োজনে শহীদ মিনার চত্বরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ও চিত্র প্রদর্শন করা হয়।