উপজেলা নির্বাচনকে ‘ফাঁদ’ মনে করছে বিএনপি 

নির্বাচনের বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। আগামী সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠকে সিদ্ধান্ত হতে পারে।

বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের অনেকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাঁরা কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। যদিও এই নির্বাচন নিয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। 

বিএনপির নেতারা এ নির্বাচনকে দলের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপিকে এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন, সেটা কিছুটা হলেও কমাতে পারবে সরকার। একই সঙ্গে এই প্রচারও শুরু করবে যে সংসদ নির্বাচন না করে বিএনপি ভুল করেছে।

দলটির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, বিএনপি দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবে না, এটি আগে থেকে নীতিগত সিদ্ধান্ত। দলের কেউ স্বতন্ত্রভাবে এই নির্বাচনে অংশ নিলে তাঁর বিরুদ্ধে দল কতটা কঠোর হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। যদিও এরই মধ্যে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ৪ মার্চ বগুড়ায় এক কর্মসূচিতে বলেছেন, বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে যাবে না। দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচনে গেলে তাঁর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

বিএনপির নেতারা এ নির্বাচনকে দলের জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করছেন, বিএনপিকে এ নির্বাচনে গেলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন, সেটা কিছুটা হলেও কমাতে পারবে সরকার।

উপজেলা নির্বাচন অংশগ্রহণ বা বর্জনের বিষয়ে দলীয়ভাবে এখন পর্যন্ত কোনো ঘোষণা না এলেও রিজভীর এই বক্তব্যকে অনেকে গুরুত্বের সঙ্গে নিচ্ছেন। তাঁরা মনে করছেন, দলের শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে কোনো ইঙ্গিত না পেয়ে হঠাৎ করে রিজভী এমন নীতিনির্ধারণী বক্তব্য দেননি। 

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটি, যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদক পর্যায়ে পাঁচজন নেতার সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁরা এ নির্বাচনকে নানাভাবে মূল্যায়ন করছেন। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, নেতা-কর্মী ও জনসমর্থন ধরে রাখতে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়া উচিত। তবে বেশির ভাগ নেতাই এ নির্বাচনকে বিএনপির জন্য ‘ফাঁদ’ হিসেবে দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, দুটি কৌশল থেকে সরকার এবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। কারণ, যেকোনোভাবে বিএনপিকে এ নির্বাচনে আনা গেলে তাদের ‘একতরফা’ ও ‘ডামি’ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন, সেটি কিছুটা হলেও কমাতে পারবে। তারা দেখাতে পারবে বিএনপি সংসদ নির্বাচন না করে ভুল করেছে।

আরও পড়ুন

বিএনপির নেতারা মনে করেন, অন্য কৌশলটি হচ্ছে, বিএনপিবিহীন গত সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবং তাদের দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর নির্বাচনের কারণে মাঠপর্যায়ে দলে বিরোধ ও দ্বিধাবিভক্তি এসেছে। সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে দলের ৬২ জন জয়ী হন। এখন উপজেলা নির্বাচন দলীয়ভাবে করতে গেলে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের ভরাডুবি হতে পারে দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে। মূলত সংসদ নির্বাচনে এর ইঙ্গিত পেয়ে এবার আওয়ামী লীগ উপজেলা নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

অন্যদিকে বিএনপিকে নির্বাচনে আনার এটি একটি কৌশল হিসেবে নেওয়া হয়েছে। সরকারি দলের এসব কৌশলের মধ্যে বিএনপি নির্বাচনে গেলেও ভালো করতে পারবে না। হাতে গোনা কয়েকটিতে হয়তো জিততে পারবে, তাতে এ সরকারের অধীন নির্বাচন না করার বিএনপির দীর্ঘদিনের আন্দোলনে তৈরি হওয়া নৈতিক অবস্থান নষ্ট হবে।

তাঁরা মনে করেন, দুটি কৌশল থেকে সরকার এবার দলীয় প্রতীকে উপজেলা নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর প্রথমটি হচ্ছে, সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপিকে নির্বাচনে আনা। কারণ, যেকোনোভাবে বিএনপিকে এ নির্বাচনে আনা গেলে তাদের ‘একতরফা’ ও ‘ডামি’ সংসদ নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্ক ও প্রশ্ন, সেটি কিছুটা হলেও কমাতে পারবে।

নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত এখনো বহাল

অবশ্য আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ২০২১ সাল থেকে বিএনপি স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন বর্জন করে আসছে। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে যাঁরা সিটি করপোরেশন, উপজেলা পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছিলেন, তাঁদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। এখনো বিএনপি সেই সিদ্ধান্তেই আছে বলে জানা গেছে। সর্বশেষ ৯ মার্চ অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচনেও বিএনপি অংশ নেয়নি। সেখানে দলের সাবেক দুই নেতা মো. মনিরুল হক (সাক্কু) ও মোহাম্মদ নিজামউদ্দিন (কায়সার) প্রার্থী হন। এই দুজন ২০২২ সালে কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে অংশ নিয়ে দল থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তাঁদের বহিষ্কারাদেশ এখনো প্রত্যাহার করা হয়নি।

এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে রুহুল কবির রিজভী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যতটুকু জানি, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির আগের সিদ্ধান্তই বহাল আছে। এর ব্যত্যয় হয়েছে বলে জানি না।’

নির্বাচনে গেলে ‘নৈতিক’ অবস্থান দুর্বল হবে

বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা বলছেন, যেসব কারণে বিএনপি ৭ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, সেগুলো এখনো বিদ্যমান রয়েছে। বরং সংসদ নির্বাচন বর্জন করে এখন উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিলে রাজনৈতিকভাবে বিএনপির ‘নৈতিক অবস্থান’ দুর্বল হয়ে যাবে। যাঁরা বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে যাননি, তাঁরা বিএনপির নির্বাচনে অংশ নেওয়াটা ভালোভাবে নেবেন না। এ ছাড়া এই মুহূর্তে বিএনপি নির্বাচন করার মতো পরিস্থিতিতে নেই। মামলা ও কারাগারে গিয়ে হাজার হাজার নেতা-কর্মী আর্থিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

দলের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি রাতে বিএনপির বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মতবিনিময় সভায় রমজান-পরবর্তী আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি উপজেলা নির্বাচনের প্রসঙ্গও ওঠে। সেখানে নেতাদের সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে মত দেন। এ বৈঠকে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামও উপস্থিত ছিলেন। এরপর স্থায়ী কমিটির একটি বৈঠকেও উপজেলা নির্বাচনের প্রসঙ্গ আসে। তখন সময়মতো আলোচনার পর সিদ্ধান্তের কথা হয়।

উপজেলা নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন করার অনেকের হয়তো শখ আছে, কিন্তু সুযোগ কই। যে নির্বাচনে সরকার পরিবর্তন হয়, সে নির্বাচনেই তো আমরা যাইনি, এখন অন্য নির্বাচনে যাব কীভাবে।’

আমি যতটুকু জানি, নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির আগের সিদ্ধান্তই বহাল আছে। এর ব্যত্যয় হয়েছে বলে জানি না।’
রুহুল কবির রিজভী

সোমবার সিদ্ধান্ত হতে পারে

আগামী সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠক আছে। তার আগে ১৮ দিন পর আজ শনিবার সন্ধ্যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছেন। মহাসচিবের উপস্থিতিতে উপজেলা পরিষদের নির্বাচনসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হতে পারে বলে বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্র জানিয়েছে। কারণ, নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে উপজেলা নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে। আগামী ৮ মে প্রথম ধাপে ১৫২টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ভোট হবে। এখন নেতা-কর্মীদের এ বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত জানাতে হবে।

চুয়াডাঙ্গা জেলা বিএনপির সদস্যসচিব মো. শরীফুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভোটের লড়াইয়ের জন্য সব সময় মানসিকভাবে প্রস্তুত। আমাদের দলে অনেক যোগ্য প্রার্থী আছেন। তবে সবার ঊর্ধ্বে দলের কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত। দলের সম্মতি ছাড়া একজনও ভোটে নামবে না।’

আগামী সোমবার দলের স্থায়ী কমিটির নিয়মিত বৈঠক আছে। তার আগে ১৮ দিন পর আজ শনিবার সন্ধ্যায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরছেন।