আওয়ামী লীগের কার্যালয়: ভুতুড়ে পরিবেশ, নাক চেপেও সামনে দিয়ে হাঁটা দায়
সুসজ্জিত ভবনটি এখন অনেকটাই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। ভেতরের সব আসবাব লুট করে নিয়ে যাওয়ার পর এটি পরিত্যক্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে। পোড়া এই ভবনের নিচতলা শৌচাগার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ছয় মাস ধরে মলমূত্র জমে থাকার কারণে উৎকট গন্ধ আশপাশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ জন্য ভবনের সামনের সড়কে নাক চেপেও হাঁটা দায়।
রাজধানীর গুলিস্তানে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের বর্তমান চিত্র এটি। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ভবনটিতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর আগস্ট মাসজুড়ে চলে লুটপাট। কেবল এই ভবনই নয়, রাজধানীর তেঁজগাওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ও ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়েও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকেও মালামাল লুট করে নেওয়া হয়। তখন থেকে এই তিন ভবন অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
গত মঙ্গলবার এ তিনটি কার্যালয় সরেজমিনে ঘুরে দেখেছেন এই প্রতিবেদক। তাতে এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা দেখা গেছে গুলিস্তান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে।
ভবঘুরে লোকদের ঠিকানা
মঙ্গলবার বেলা দুইটার দিকে গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির নিচতলা লোকজন গণশৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করছেন। উৎকট গন্ধের কারণে নাক চেপে মানুষ এই ভবনের সামনের অংশ পার হচ্ছেন। এ সময় বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে ভবনের নিচতলায় গিয়ে প্রস্রাব করতে দেখা যায়। পুরুষের পাশাপাশি নারীদের শৌচাগার হিসেবেও এই ভবনের নিচতলা ব্যবহার করা হচ্ছে।
ভবনটির ভেতরে প্রবেশের পর দেখা যায়, নিচতলায় দুটি কক্ষে নোংরা পানি জমে আছে। পুরো ফ্লোরে ময়লা–আবর্জনার স্তূপ। সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখা গেল বাথরুম থেকে শুরু করে সব কক্ষের মালামাল লুট করার পর এসব কক্ষ ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসবের ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। প্রতিটি কক্ষের দরজাও খুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দরজা খুলতে গিয়ে ভবনের দেয়াল ভাঙতে হয়েছিল। সেখানে ইটের খোয়া ও কাচের টুকরা পড়ে আছে। ছয়তলায় গিয়ে দেখা গেল, সেখানে কয়েকজন মানুষ স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাঁদের ছিন্নমূল মানুষ মনে হয়েছে। কত দিন ধরে থাকছেন জানতে চাইলে তাঁরা বলেন, বেশ কয়েক দিন ধরে তাঁরা এই ভবনে আছেন। রাতে আরও অনেক লোক ভবনে আসেন বলে জানান তাঁরা।
ভবন থেকে বেরিয়ে কথা হয় এই কার্যালয়ের সামনের এক ভ্রাম্যমাণ দোকানির সঙ্গে। শরীয়তপুর সদর উপজেলার এই বাসিন্দা জানান, ৪০ বছর ধরে তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ব্যবসা করেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এই দশা নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। কেবল বললেন, ‘ক্ষমতা যে চিরস্থায়ী নয়, এটা সকলের বোঝা উচিত।’ পাশের আরেক দোকানির কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্থানীয় হকার থেকে শুরু করে পথচারীরাও ভবনটিকে শৌচাগার হিসেবে ব্যবহার করছেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা লোকজনকে এখানে শৌচকাজ সারতে তাঁরা দেখেছেন। আরও কয়েকজন দোকানির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাঁরা এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
গুলিস্তানে ২৩ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ১০ তলাবিশিষ্ট আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়টি ২০১৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন করেছিলেন দলের সভাপতি ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সেখানে দৃষ্টিনন্দন ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল।
পাহারা দিচ্ছেন বিএনপির নেতা
তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের চিত্রও অনেকটা একই রকম। এই কার্যালয়েও আগুন ধরিয়ে দেওয়ার পর মালামাল লুট করা হয়েছিল। পরিত্যক্ত এই ভবন এখন দেখে রাখছেন স্থানীয় বিএনপির এক নেতা। রফিক মাতব্বর নামের এই নেতা নিজেকে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল এলাকার ৪ নম্বর ইউনিট বিএনপির সভাপতি পরিচয় দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিনিয়ত ছিন্নমূল লোকজন এসে অবশিষ্ট মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন। এসব ঠেকাতে তিনি কার্যালয়ের একটি ফটকে তালা দিয়েছেন। আরেকটি ফটক খুলে নেওয়ার পর সেখানে বিভিন্ন জিনিস রেখে প্রবেশপথ বন্ধ করেছেন, যাতে কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে।
এই কার্যালয় ঘুরে দেখা যায়, আগুনের পোড়া চিহ্ন এখনো ভবনটিতে রয়েছে। প্রতিটি কক্ষ ভাঙচুরের পর সেখানে ধ্বংসাবশেষ পড়ে আছে। এই ভবনে কাচের ব্যবহার বেশি করা হয়েছিল। ভবনটির নিচতলা ও দোতলায় অসংখ্য কাচের টুকরা পড়ে আছে। নিচতলায় নব্বইয়ের দশকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শেখ হাসিনার পুরোনো কিছু ছবি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এই কার্যালয় স্টিলের অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। স্টিল ছাড়া এখানকার বাকি সবই লুট করা হয়েছে।
বিএনপির এই নেতার পাশাপাশি এই কার্যালয়ের পাহারায় একজন নিরাপত্তা প্রহরীও রয়েছেন। অহিদুল হক নামের ওই নিরাপত্তাকর্মী প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পর তিনি সেখানে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত হয়েছেন। বেক্সিমকো গ্রুপ থেকে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হলেও এখন পর্যন্ত এক টাকাও বেতন পাননি।
২০২৩ সালের ৩ জুন এই কার্যালয়ের উদ্বোধন করা হয়েছিল। আশপাশের লোকজন জানান, ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের কোনো পর্যায়ের নেতা–কর্মীদের এই কার্যালয়ের আশপাশেও ঘোরাঘুরি করতে দেখেননি।
ভুতুড়ে দশা
ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ের প্রবেশপথ থেকে শুরু করে ভেতরের সব কক্ষই ভাঙচুর করা হয়েছিল। সেখানে মঙ্গলবার বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে কাঠের বেড়া দিয়ে প্রবেশপথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেন না। কার্যালয়ের সামনে ২৪ বছর ধরে চা বিক্রি করেন এক ব্যক্তি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ আগস্টের পরও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীরা কার্যালয়ের সামনে আসতেন। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পর থেকে আর কেউ আসেন না। পুলিশ মুঠোফোন তল্লাশি করার কারণে কার্যালয়ে আসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে। তবে বিকেলে বিএনপির লোকজন কার্যালয়ের সামনে আড্ডা দেন।
আগুন জ্বালিয়ে দেওয়ার পর ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন মো. কাউছার নামের এক ব্যক্তি। মঙ্গলবার ওই কার্যালয়ের সামনে পাওয়া গেল তাঁকে। ধানমন্ডি এলাকায় ১৫ বছর ধরে রিকশা চালান জানিয়ে পঞ্চগড় জেলার এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, ভেতরে কিছু নেই। সব নিয়ে গেছে। ভাঙচুরও করা হয়েছে। আগে কার্যালয়ের ভেতর ও সামনের রাস্তায় মানুষ গিজগিজ করত। এখন ভেতরে ভুতুড়ে পরিবেশ আর বাইরে জনশূন্য অবস্থা।