সব হলে সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ, খাবারের মানোন্নয়ন ও গবেষণায় জোর দেওয়াসহ নানা প্রতিশ্রুতি

মধুর ক্যানটিনে ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেন কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন–সমর্থিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেলের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু। ঢাকা, ৩১ আগস্টছবি: প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে ইশতেহার ঘোষণা করেছে কয়েকটি বামপন্থী ছাত্রসংগঠন–সমর্থিত ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’ প্যানেল। আজ রোববার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যানটিনে ১৮ দফা ইশতেহার ঘোষণা করে তারা।

প্রতিরোধ পর্ষদের পক্ষে জিএস (সাধারণ সম্পাদক) প্রার্থী মেঘমল্লার বসু ইশতেহার পাঠ করেন। ডাকসুর কাঠামোর সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণায় অগ্রাধিকার, হলে সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ ও আবাসনসংকট দূর করা, নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা, সব জাতিসত্তার অধিকার নিশ্চিত করাসহ আরও অনেক বিষয় উঠে এসেছে তাঁদের ইশতেহারে।

ডাকসুর কাঠামোর সংস্কার ও ক্ষমতা বৃদ্ধি শিরোনামে একাডেমিক ক্যালেন্ডারে কেন্দ্রীয় এবং হল সংসদ নির্বাচনের তারিখ সুনির্দিষ্ট করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া সিনেটের কোরাম পূর্ণ করতে ন্যূনতম দুজন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধির উপস্থিত থাকার বাধ্যবাধকতা রেখে ’৭৩-এর অধ্যাদেশ সংশোধন করা। সিনেটে ৫ জনের পরিবর্তে ন্যূনতম ১০ জন নির্বাচিত ছাত্র প্রতিনিধি রাখার বিধান যুক্ত করা। হল সংসদ এবং কেন্দ্রীয় সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অপসারণ বা কোনো কারণে বিলুপ্ত করতে হলে তা শিক্ষার্থীদের গণভোটের মাধ্যমে হওয়া। কোনোভাবেই প্রাধ্যক্ষ ও উপাচার্যের হাতে এ ক্ষমতা না রাখা এবং অনুষদভিত্তিক শিক্ষার্থী প্রতিনিধি নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে।

ইশতেহারে ‘শিক্ষার্থীদের ক্ষমতায়ন করে শিক্ষার মানোন্নয়ন’ নিয়ে বলা হয়েছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ-বেসরকারীকরণ-সংকোচন নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। এ ছাড়া শিক্ষক মূল্যায়ন ব্যবস্থা সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবগত করা এবং মূল্যায়নের ওপর ভিত্তি করে বিভাগের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। উপস্থিতির হারের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত না করা এবং নন–কলেজিয়েট/ডিজকলেজিয়েট ফির নামে জরিমানা বাতিল, অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

‘গবেষণায় অগ্রাধিকার’ শিরোনাম অংশে বলা হয়, গবেষণার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেটের অন্তত ১০ শতাংশ গবেষণা খাতে বরাদ্দ নিশ্চিত করা হবে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে প্রতিটি গবেষণাগারের আধুনিকায়নের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বিভাগে গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করতে উদ্যোগ নেওয়া এবং বছর শেষে গবেষণা প্রকল্পের অগ্রগতি সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের অবগত করা। গবেষণা প্রকল্পে শিক্ষার্থীদের রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্টশিপ, রিসার্চ ফেলোশিপ দেওয়া। থিসিস নেওয়ার ক্ষেত্রে সিজিপিএর প্রতিবন্ধকতা দূর করা।

আবাসনসংকট নিরসন বিষয়ে ইশতেহারে সব হলে সন্ত্রাস-দখলদারি বন্ধ করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া পুরোনো ভবনগুলোর সংস্কার, সম্প্রসারণ এবং নতুন ভবন নির্মাণ করতে প্রশাসনকে বাধ্য করা। প্রথম বর্ষ থেকেই প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে আসন নিশ্চিত করা। হলের ভেতর জোরপূর্বক রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক কর্মসূচিতে নেওয়া কিংবা কর্মসূচিতে যেতে বাধা দেওয়া বন্ধ করা। গণরুম, গেস্টরুম ও র‍্যাগিং প্রথা নিষিদ্ধ করে ক্যাম্পাস চার্টার প্রকাশ। হলগুলোতে পর্যাপ্ত সিসিটিভি কার্যকর থাকা নিশ্চিত করা।

নারীবান্ধব ক্যাম্পাস নিয়ে বলা হয়েছে, নারী শিক্ষার্থীদের সাইবার সুরক্ষা, চলাফেরার স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে প্রশাসনকে বাধ্য করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করার সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা। প্রতিটি ফ্যাকাল্টি, নারী হল ও ডিপার্টমেন্টগুলোতে কার্যকর ভেন্ডিং মেশিন স্থাপন। গর্ভবতী ও সদ্য মা হওয়া নারী শিক্ষার্থীদের জন্য ইনটেনসিভ কেয়ার সেন্টার ও ব্রেস্টফিডিং কর্নার স্থাপনসহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নারীদের হলে প্রবেশের সময়সীমা প্রত্যাহার করা। উক্ত হলে আবাসিক-অনাবাসিক নারী শিক্ষার্থীদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।

ইশতেহারে পাহাড় ও সমতলের সব জাতিসত্তার ভাষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা এবং সব জাতিগোষ্ঠীর সমমর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করার কথা বলেছে প্রতিরোধ পর্ষদ।

খাদ্য ও পুষ্টিমান সুরক্ষা শিরোনামে হলগুলোত ব্যক্তিমালিকাধীন ক্যানটিনের পরিবর্তে প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ক্যাফেটেরিয়া চালু করার কথা বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, প্রতি বেলা খাবারে অন্তত ৮০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি নিশ্চিত করা। ভর্তুকি দিয়ে খাবারের দাম কমানো, মান বাড়ানো। খাবারে বৈচিত্র্যময় মেনু নিশ্চিত করা। রাত ১২টা পর্যন্ত খাবারের ব্যবস্থা রাখা।

শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ে বলা হয়েছে, শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারকে আধুনিক এবং ন্যূনতম ১০০ শয্যায় উন্নীত করা। ২৪ ঘণ্টা সেখানে পর্যাপ্ত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স ও চালক নিশ্চিত করতে কাজ করবে তারা।

মেডিকেল সেন্টারের আওতায় ‘মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেন্টার’ গড়ে তোলা এবং অনলাইন-অফলাইনে সেবা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে। এ ছাড়া নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ও টিএসসির থেরাপি সেন্টারের পাশাপাশি থেরাপি ইউনিট বৃদ্ধি করা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে মানসিক চাপ, হতাশা, আসক্তি ও আত্মহত্যা প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরি করা এবং মাদকমুক্ত ক্যাম্পাস গড়ে তোলার কথাও উঠে এসেছে ইশতেহারে।

লাইব্রেরি, সেমিনার, রিডিংরুম ও কমনরুম শিরোনামে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত রাখতে হবে। নতুন লাইব্রেরি ভবন নির্মাণসহ প্রতিটি অনুষদের শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ কমনরুম নির্মাণে কাজ করা হবে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা সংস্থাকে সচল করা এবং নিয়মিত বিভিন্ন বই ও গবেষণাপত্র প্রকাশের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে প্রতিরোধ পর্ষদ। এ ছাড়া মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা অর্জনের লক্ষ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ অনুবাদকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কাজের সূচনা করা এবং শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে গবেষণা প্রবন্ধ নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার কথাও বলেছে তারা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেহাত হওয়া জমি পুনরুদ্ধার এবং অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে মুক্ত পরিসর সংকুচিত ও পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেদিকে নজর রাখার কথা বলেছে প্রতিরোধ পর্ষদ। তাদের ভাষ্যমতে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ শিক্ষার্থী এবং ডাকসু প্রতিনিধিদের যুক্ত করে পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন করতে হবে।

সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে প্রতিরোধ পর্ষদ বলেছে, হলগুলোতে নৃত্যকলা, নাট্যকলা, সংগীত ও চারুকলার শিক্ষার্থীদের অনুশীলনের জন্য আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা করতে হবে। হল অডিটরিয়ামগুলোকে সংস্কার ও সক্রিয় করার উদ্যোগ নিতে হবে। হল-অনুষদে নিয়মিত সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক আড্ডার আয়োজন করা হবে। সাহিত্য-সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা হবে।

পরিবহন বিষয়ে প্রতিরোধ পর্ষদ বলেছে, বিআরটিসি থেকে ভাড়াভিত্তিক নয়, নিজস্ব অর্থায়নে বাস কিনতে হবে। মেরামত কারখানাসহ পূর্ণাঙ্গ পরিবহন ব্যবস্থা এবং এ–বিষয়ক নীতিমালা গড়ে তুলতে হবে। বাসের রুট ও ট্রিপ বাড়াতে হবে। রাত আটটা পর্যন্ত বাস সার্ভিস চালু রাখা এবং শনিবারে একাডেমিক প্রয়োজন ও পরীক্ষার্থীদের জন্য বাস সার্ভিস চালু রাখার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

ক্রীড়া বিষয়ে ইশতেহারে বলা হয়, বার্ষিক স্পোর্টস ক্যালেন্ডার তৈরি করা হবে, যা একাডেমিক ক্যালেন্ডারের সঙ্গে সমন্বিত হবে। নতুন মাঠ বৃদ্ধি ও পরিত্যক্ত মাঠ উদ্ধার করে ব্যবহারযোগ্য করে তুলতে হবে। কেন্দ্রীয় ও হলগুলোর মাঠ হবে শুধু খেলার জন্য, বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারের জন্য নয়—বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশ ও প্রতিবেশ সুরক্ষা নিয়ে প্রতিরোধ পর্ষদ বলেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানে প্রয়োজনমাফিক গণশৌচাগার স্থাপন ও প্রতিদিন রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা। বিরল ও পুরোনো গাছগুলোকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া এবং পরিকল্পিত সবুজায়ন করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে যে জীববৈচিত্র্য রয়েছে তার ডেটাবেজ তৈরি করতে হবে। জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে সেল গঠন করতে হবে। মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া গাছ কাটা নিষিদ্ধ করতে হবে।

গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন ও মতপ্রকাশের অধিকার নিয়ে প্রতিরোধ পর্ষদ বলেছে, ’৭৩-এর অধ্যাদেশের অগণতান্ত্রিক ধারা বাতিল করে পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। প্রশাসনিক এবং একাডেমিক কোনো কাজেই রাষ্ট্র-সরকারের হস্তক্ষেপ চলবে না। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর মানবাধিকার, মতপ্রকাশ এবং সংগঠন করার অধিকার নিশ্চিত করা। সাম্প্রদায়িক, জাতিগত ও লৈঙ্গিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী সব তৎপরতা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড (প্রতিবন্ধী) শিক্ষার্থীবান্ধব ক্যাম্পাস গড়ে তুলতে উদ্যোগ নেওয়া।

সবশেষে মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন শিরোনামে প্রতিরোধ পর্ষদের ইশতেহারে বলা হয়, মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা, গবেষণা বৃত্তি নিশ্চিত করা এবং ত্রৈমাসিক প্রকাশনা বের করা হবে। জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিসরে সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সংহতি, বিশ্বব্যাপী যুদ্ধবিরোধী অবস্থান এবং স্বাধীন ফিলিস্তিনের পক্ষে জনমত গঠনে কাজ করা হবে।