পাঁচ সিটি নির্বাচন তিন পক্ষের জন্যই বড় পরীক্ষা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপি এবং নির্বাচন কমিশন—তিন পক্ষকেই বড় পরীক্ষায় ফেলেছে আসন্ন পাঁচ সিটি নির্বাচন। তিনটি পক্ষই মনে করে, এসব নির্বাচনের প্রভাব পড়তে পারে জাতীয় নির্বাচনে। এখানে কোনো পক্ষের কৌশলে ভুল হলে সেই পক্ষকে বড় মাশুল দিতে হবে। তবে তিনটি পক্ষের কৌশল ও চ্যালেঞ্জ কিন্তু একই রকমের নয়। তিন পক্ষের পরীক্ষা তিন রকমের।

পাঁচ সিটির এই নির্বাচনে বিএনপি শেষ পর্যন্ত কী কৌশল নেয়, আওয়ামী লীগ বা সরকার এবং নির্বাচন কমিশন কেমন আচরণ করে, সেদিকে দেশের ভেতরের এবং বাইরের সবার নজর থাকবে। জাতীয় নির্বাচনের আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায়, তা নিয়ে নানা আশঙ্কা রয়েছে নানা মহলে।

নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা বিএনপির জন্য এই পরীক্ষা বেশ জটিল। কারণ, সিটি নির্বাচন নিয়ে দলের ভেতরে কোনো মেরুকরণ হয় কি না, সেখানে সরকারের কোনো কৌশল থাকে কি না—এমন নানা আলোচনা রয়েছে দলটিতে।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হবে আগামী ২৫ মে। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটে ভোট।

ভোটে না গেলেও বিএনপির জন্য পরীক্ষা

আন্দোলনের অংশ হিসেবে বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার পুরোনো অবস্থানেই অটল রয়েছে বিএনপি। সেই অবস্থানে থেকে দলটি সিটি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। কিন্তু নির্বাচনে অংশ নেওয়া না-নেওয়ার প্রশ্নে মাঠপর্যায়ের চাপ রয়েছে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের ওপর।

পাঁচ সিটির মধ্যে সিলেটের বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী আবারও নির্বাচন করতে পারেন—এমন আগ্রহ প্রকাশ পাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে দলের শীর্ষ পর্যায়ে আলোচনা করতে তিনি লন্ডন পর্যন্ত গিয়েছিলেন। খুলনায় বিএনপির নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু নির্বাচন নিয়ে তাঁর আগ্রহের কথা প্রকাশ্যেই বলছেন। গাজীপুরে বিএনপির নেতা হাসান উদ্দিন সরকার ক্ষমতাসীন দলকে খালি মাঠে গোল দিতে দেওয়া হবে না বলে বক্তব্য দিচ্ছেন। এই নেতারা যদি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নেন এবং পেছন থেকে অনানুষ্ঠানিকভাবে তাঁদের সমর্থন দিতে হয়, তখন এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়ে বিএনপির অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ সৃষ্টি হবে। আবার বিএনপি নির্বাচনে কোনোভাবেই অংশ না নেওয়ার অবস্থানে অটল থাকলে মাঠের নেতাদের আগ্রহের সুযোগ ব্যবহার করে সরকার ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের ‘উকিল সাত্তার’ মডেলের পুনরাবৃত্তির কৌশল নিতে পারে। জাতীয় নির্বাচনেও এমন কৌশলের ব্যাপারে সরকার তখন উৎসাহী হবে—এমন নানা আশঙ্কাও রয়েছে বিএনপিতে।

আরও পড়ুন
সিটি নির্বাচনকে তাঁরা বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। সে জন্য তাঁরা এই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করবেন
আব্দুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী

জাতীয় নির্বাচনের আগে বিএনপি যখন তাদের আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কথা বলছে, তখন আরিফুল হক চৌধুরী বা নজরুল ইসলামের মতো নেতারা যদি সিটি নির্বাচনে অংশ নেন, তখন দলের ভেতরকার ঐক্য ও সংহতি নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। পাশাপাশি বিএনপির জন্য বাইরের চ্যালেঞ্জও দেখছেন পর্যবেক্ষকদের অনেকে। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী বেসরকারি সংস্থা ফেমার প্রধান মুনিরা খান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যদি সিটি নির্বাচনে অংশ না নেয় এবং এই নির্বাচন ভালো হয়, তা দলটিকে অস্বস্তিতে ফেলবে। কারণ, দেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তখন সরকার দেখানোর চেষ্টা করবে যে এই সরকারের অধীনেই ভালো নির্বাচন হচ্ছে।

তবে বিএনপি সিটি নির্বাচনে দলগতভাবে অংশ নেবে না, এটি তারা পরিষ্কার করেছে। আগ্রহীরা দলের অবস্থানের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হলে বিএনপির কৌশল কী হবে, সেটা এখনো স্পষ্ট নয়।

বিএনপি নেতৃত্ব মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে সিটি নির্বাচন নিয়ে সরকার বিএনপিকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করবে। দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলে আসছেন, তাঁরা এই ফাঁদে কোনোভাবেই পা দেবেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সিটি নির্বাচন ঘিরে তাঁরা দলের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন না। তাঁদের সামনে চ্যালেঞ্জ একটিই, সেটি হচ্ছে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আদায় করা। সেই লক্ষ্যে তাঁরা অটল থাকবেন।

জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনকে সদিচ্ছার প্রকাশ দেখাতে হবে। তা না হলে তাদের প্রতি আস্থার সংকট আরও বাড়বে
মুনিরা খান, নির্বাচন পর্যবেক্ষক

পরীক্ষার মুখে ক্ষমতাসীন দল এবং নির্বাচন কমিশন

সিটি নির্বাচন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি করেছে। এর কারণ, দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই প্রশ্ন শুধু বিরোধী দলগুলোই করছে তা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও নির্বাচন নিয়ে আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত সংসদের বিভিন্ন আসনের উপনির্বাচন এবং স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারদের আগ্রহের ঘাটতি ছিল চোখে পড়ার মতো।

একদিকে এই বাস্তবতা, অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনের আগে নির্দলীয় সরকারের দাবিতে বিরোধী দলের অব্যাহত আন্দোলন—এমন পটভূমিতে পাঁচ সিটির নির্বাচন একতরফা করা হলে তাতে রাজনৈতিক সংকট আরও বাড়তে পারে। সেই পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনদের জন্য নেতিবাচক হবে।

এ ছাড়া বিরোধী দল নির্বাচনে না থাকলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ঘিরে দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল বেড়ে যেতে পারে এবং বিদ্রোহী প্রার্থী মোকাবিলা করতে হতে পারে। পাঁচ সিটির মধ্যে গাজীপুর, সিলেট ও বরিশালে সে ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। রাজশাহী ও খুলনায় অবশ্য সে রকম পরিস্থিতি নেই।

অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে চ্যালেঞ্জ এক রকম হতো। আর অংশগ্রহণমূলক না হলে চ্যালেঞ্জ ভিন্ন রকম। নির্বাচন নিয়ে মানুষের আস্থা বাড়ানোর জন্য সিটি নির্বাচনকে তাঁরাও খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন।
মো. আনিছুর রহমান, নির্বাচন কমিশনার
আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগ বা সরকারের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক বা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার বিষয়টিকে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছেন দলটির নেতাদের অনেকে। তাঁদের কেউ কেউ বলেছেন, নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক করার জন্য বিএনপির আগ্রহীরা যেন প্রার্থী হন, সেটি তাঁরা চাইছেন। সেখানে সরকারেরও ভূমিকা থাকতে পারে, এমন ইঙ্গিতও দলটির কেউ কেউ দিচ্ছেন।

ভোটাররা যে নির্বাচন নিয়ে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন, এই বিষয়টিও আওয়ামী লীগের মধ্যে আলোচনায় রয়েছে। দলটির নেতাদের কেউ কেউ বলছেন, বিএনপি থেকে কেউ যদি ব্যক্তিগতভাবেও প্রার্থী না হন, সেই পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের বড় লক্ষ্য কেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানো। নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক না হলেও ভোটারের আস্থা আছে—অন্তত এই বিষয়টি যাতে দেখানো যায়।

সিটি নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হলে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির আন্দোলনের পক্ষে যুক্তিকে আরও জোরালো করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। আওয়ামী লীগও সেটা বিবেচনায় নিচ্ছে, এমন আভাস দলটির নেতাদের বক্তব্যে পাওয়া যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতির কারণে সিটি নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করার একটা তাগিদ বা চাপ রয়েছে ক্ষমতাসীনদের ওপর।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, সিটি নির্বাচনকে তাঁরা বেশ গুরুত্ব দিচ্ছেন। সে জন্য তাঁরা এই নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করার চেষ্টা করবেন।

নির্বাচন যারা পরিচালনা করবে, সেই নির্বাচন কমিশনের প্রতিই আস্থার সংকট এখন বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি সরকারের প্রভাবের বাইরে থেকে নির্বাচন কমিশন কতটা স্বাধীন ভূমিকা রাখতে পারছে, তা সিটি নির্বাচনে অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে যাবে।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক মুনিরা খান মনে করেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে পাঁচ সিটি নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ও গ্রহণযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনকে সদিচ্ছার প্রকাশ দেখাতে হবে। তা না হলে তাদের প্রতি আস্থার সংকট আরও বাড়বে।

নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে চ্যালেঞ্জ এক রকম হতো। আর অংশগ্রহণমূলক না হলে চ্যালেঞ্জ ভিন্ন রকম। তবে যে চ্যালেঞ্জই আসুক না কেন, তাঁরা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার চেষ্টা করবেন। তিনি এ-ও বলেন, নির্বাচন নিয়ে মানুষের আস্থা বাড়ানোর জন্য সিটি নির্বাচনকে তাঁরাও খুব গুরুত্ব দিচ্ছেন।

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট হবে আগামী ২৫ মে। খুলনা ও বরিশালে ভোট হবে ১২ জুন। আর ২১ জুন রাজশাহী ও সিলেটে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।

সিটি নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের মাত্র কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে সিটি নির্বাচন। সে কারণে এই নির্বাচনের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। এই নির্বাচন কেমন হয়, সেদিকে সবার নজর থাকবে।