বিএনপির শীর্ষ নেতারা আত্মগোপনে

  • মির্জা ফখরুলসহ বিএনপির ২০ কেন্দ্রীয় নেতা গ্রেপ্তার।

  • সারা দেশে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা ৬ শতাধিক।

  • ৬ শতাধিক নেতার মধ্যে গ্রেপ্তার ৮৫ জন।

  • আত্মগোপনে রয়েছেন কমপক্ষে ৩৮৬ জন।

বিভিন্ন মামলায় গ্রেপ্তার নেতা–কর্মীরা প্রিজন ভ্যানে। তাঁদের দেখতে এসেছেন স্বজনেরা
প্রথম আলো ফাইল ছবি

জামালপুরের সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনের কাছে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে ১৮ নভেম্বর মধ্যরাতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ট্রেনের তিনটি বগি পুড়ে যায়। এ ঘটনায় সহকারী স্টেশনমাস্টার মামলা করেন। এই এক মামলাতেই জামালপুর জেলা, সদর ও সরিষাবাড়ী উপজেলা বিএনপি এবং এর চার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব নেতাকে আসামি করা হয়। এরপর জামালপুর অনেকটা বিএনপিশূন্য। গ্রেপ্তার এড়াতে বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, কৃষক দল ও মৎস্যজীবী দলের প্রায় সব নেতাই গা ঢাকা দিয়েছেন।

সারা দেশ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সারা দেশে বিএনপির অবস্থা অনেকটাই জামালপুরের মতো। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির ঢাকার মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে পুলিশি অভিযানের মুখে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে নতুন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছেন। বাকিরা আত্মগোপনে রয়েছেন।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন অসুস্থ, কারাবন্দী অবস্থা থেকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান দেড় দশক ধরে যুক্তরাজ্যে, একাধিক মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। মহাসচিব মির্জা ফখরুলসহ ইতিমধ্যে ২০ জন কেন্দ্রীয় ও শীর্ষস্থানীয় নেতা গ্রেপ্তার হয়েছেন।

সারা দেশে জেলা ও মহানগরে বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ দুই পদের (সভাপতি/আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক/সদস্যসচিব) নেতার সংখ্যা ৬ শতাধিক। প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, বিএনপি ও এর তিন অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদে থাকা ৮৫ জন নেতা ইতিমধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ৩৮৬ জন আত্মগোপনে। ১৪৯ জনকে এলাকায় মাঝেমধ্যে দেখা যাচ্ছে, তবে বাসায় কম থাকেন বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে।

এর মধ্যে ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, সদস্যসচিব আমিনুল হকসহ পাঁচজন শীর্ষ নেতা, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্যসচিব রফিকুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত সদস্যসচিব তানভীর হাসান ছাড়া আরও তিনজন যুগ্ম আহ্বায়ককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যুবদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল মোনায়েম আগে থেকেই কারাগারে।

আরও পড়ুন

বিএনপির গতকাল বৃহস্পতিবার দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (বুধবার বিকেল থেকে গতকাল বিকেল পর্যন্ত) সারা দেশে দলটির ৪১০ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গতকাল দেশের বিভিন্ন জায়গায় মামলা হয়েছে ১৭টি। বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তরের তথ্য বলছে, ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ১৫ হাজার ৬০০ জনকে। এ সময়ে মামলা হয়েছে ৩৮৪টির বেশি।

প্রথম আলোর প্রতিনিধিদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২৮ অক্টোবর থেকে গতকাল পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির ৯ হাজার ৫৬৪ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৩ হাজার ১০৪।

গত ২৯ অক্টোবর গ্রেপ্তার করা হয় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে। এরপর দলটির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, তিন ভাইস চেয়ারম্যান শাহজাহান ওমর, আলতাফ হোসেন চৌধুরী ও শামসুজ্জামান, দুই যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ও খায়রুল কবির, তিন সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান সালেহ, রুহুল কুদ্দুস তালুকদার ও বিলকিস জাহান (সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন) এবং কেন্দ্রীয় নেতা জহির উদ্দিন স্বপনকে গ্রেপ্তার করা হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদেরও এখন আর প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।

নির্দলীয় সরকারের অধীন সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করে আসছিল বিএনপি। কিন্তু ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ ঘিরে হামলা, সংঘর্ষ ও সহিংস ঘটনার পর দলটির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এর পর থেকে নেতা-কর্মীরা আত্মগোপনে থেকেই সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনের তফসিল বাতিলের দাবিতে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি পালন করছেন। এসব কর্মসূচি ঘিরে যানবাহনে আগুন, ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান গতকাল এক বিবৃতিতে বলেন, সরকার নির্বাচনের নামে তামাশা মঞ্চস্থ করার পরিকল্পনা করছে। জনগণের আন্দোলন অব্যাহত রেখে দেশের গণতান্ত্রিক আদর্শকে ফিরিয়ে আনতে চায় তাঁর দল।

আরও পড়ুন

বিএনপির নেতাদের অভিযোগ, আরেকটি একতরফা নির্বাচন করার জন্য সরকার ২৮ অক্টোবরের পর থেকে বিএনপির বিরুদ্ধে অনেকটা ‘ক্র্যাক ডাউন’ শুরু করেছে। গ্রেপ্তারের পাশাপাশি পুরোনো বিভিন্ন মামলায় সাজার রায়ও দেওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ গতকাল ঢাকার আদালতে পাঁচটি মামলায় ১৭৯ জন নেতা-কর্মীর সাজা হয়েছে। বিএনপির দাবি, এরই মধ্যে ২৭টি মামলায় ৯ জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ৪১৯ জনের বেশি নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়েছে।

তবে গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশকে ঘিরে সহিংসতার পর সারা দেশে মামলা ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা কমেছে বলে জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২৮ অক্টোবরের আগে সারা দেশে প্রতিদিন দুই হাজারের কাছাকাছি গ্রেপ্তার হতো ও কারাগারে যেত। আবার দুই হাজারের কাছাকাছি মুক্তি পেত। আর ২৮ অক্টোবরের পর এ সংখ্যা কমে ১ হাজার ৮১৬-তে এসেছে। ২৮ অক্টোবরের আগে সারা দেশে প্রতিদিন ৫৬৫টি মামলা হতো। আর ২৮ অক্টোবরের পর এখন পর্যন্ত প্রতিদিন ৪৩৮টি মামলা হয়েছে। ১২৭টির মতো মামলা কমেছে।

মামলা, গ্রেপ্তার ও আত্মগোপন

এক বছরের কম সময়ে জামালপুর জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ৪৭টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের শতাধিক নেতা-কর্মী এখনো কারাগারে। তবে ১৮ নভেম্বর জামালপুর শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে সরিষাবাড়ী রেলস্টেশনের কাছে যমুনা এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনার পর পুরো জেলা বিএনপি আত্মগোপনে চলে গেছে। এ ঘটনায় করা মামলায় আসামি হিসেবে জেলা বিএনপির সভাপতি ফরিদুল কবীর তালুকদার, সাধারণ সম্পাদক শাহ্ মো. ওয়ারেছ আলী মামুনসহ দলটির শীর্ষস্থানীয় ৪১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

জামালপুর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম খান ফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে গিয়ে শীর্ষস্থানীয় নেতারা রাত একটার দিকে ট্রেনে আগুন দিয়েছেন। এটা পাগলেও বিশ্বাস করবে না। এই মামলায় শহর বিএনপির সভাপতি লিয়াকত আলীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অথচ ঘটনার দিন রাতে তিনি বাসায় ছিলেন। সিসিটিভির ফুটেজ আছে।’

টাঙ্গাইল জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ ইকবালকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে ৯ নভেম্বর। তাঁর বিরুদ্ধে গত ২৯ অক্টোবর হরতাল চলাকালে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি ও পুলিশের ওপর আক্রমণের অভিযোগে পুলিশ মামলা করে। শুধু ফরহাদ ইকবাল নন, এই মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি হাসানুজ্জামিলসহ (শাহীন) ২৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। অজ্ঞাতনামা আসামি আরও ১২০ জন। এরপর জেলা বিএনপি ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের প্রায় সব নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া।

টাঙ্গাইল সদর থানা ছাড়াও মির্জাপুর, নাগরপুর, কালিহাতী, দেলদুয়ার ও গোপালপুর থানায় মামলা হয়েছে। জেলা বিএনপির নেতারা জানান, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা বাড়িতে থাকতে পারছেন না। প্রতি রাতেই পুলিশ তল্লাশি করছে।

সাম্প্রতিক সময়ে নরসিংদী জেলার ৬টি উপজেলায় বিএনপি ও এর অঙ্গ–সংগঠনের নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে অন্তত ৫০টি মামলা হয়েছে। পুলিশের করা এসব মামলায় দেড় হাজারের বেশি নেতা-কর্মী আসামি। ৬০ জনের বেশি গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন। জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবিরের (খোকন) বিরুদ্ধে রাজধানীতে একাধিক মামলা ছাড়াও নরসিংদীতে পাঁচটি মামলা রয়েছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নিজ জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপি ও অঙ্গ–সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাই গা ঢাকা দিয়েছেন। এর মধ্যে যুবদলের সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার হয়েছেন।

আত্মগোপনে থেকে ভার্চ্যুয়াল সংবাদ ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে কর্মসূচি ঘোষণা করে আসছেন বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তিনি গতকাল বলেন, সারা দেশে বিএনপি, সহযোগী সংগঠন এবং সমমনা দলগুলোর নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়ন চলছে, নির্বিচার গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।