তারেক রহমানের ফেরা ও নির্বাসিত নেতাদের রাজনীতি
ইতিহাস কখনো সরলরৈখিক পথে চলে না। রাষ্ট্রের সংকট, ক্ষমতাসীনদের দমন-পীড়ন, মতাদর্শিক সংঘর্ষ—এসবের মধ্য দিয়েই ইতিহাস তার নেতৃত্বকে বেছে নেয়। অনেক ক্ষেত্রে সেই নেতৃত্ব জন্ম নেয় নির্বাসনের অগ্নিপরীক্ষায়।
নির্বাসন তাই কেবল ভৌগোলিক বিচ্ছেদ নয়; এটি সময়ের সঙ্গে লড়াই। নিজের বিশ্বাসকে শাণিত করার পর্ব এবং প্রত্যাবর্তনের জন্য মানসিক ও রাজনৈতিক প্রস্তুতির দীর্ঘ সাধনা।
বাংলাদেশ আজ ঠিক তেমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে, যখন নির্বাসনের রাজনীতি নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই প্রেক্ষাপটে তারেক রহমানের দীর্ঘ নির্বাসন ও প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুতি শুধু সমকালীন রাজনীতির ঘটনা নয়; এটি বিশ্ব-ইতিহাসের সেই চেনা ধারার সঙ্গে যুক্ত।
নির্বাসন: পরাজয় নয়, প্রস্তুতির সময়
বিশ শতকের ইতিহাসে যেসব নেতা রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে পৌঁছেছেন, তাঁদের কারও কারও রাজনৈতিক জীবন শুরু বা পূর্ণতা পেয়েছে নির্বাসনের মধ্য দিয়ে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে ফিলিস্তিনের ইয়াসির আরাফাত বা পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের কথা। নেলসন ম্যান্ডেলা সরাসরি নির্বাসনে না থাকলেও দীর্ঘ কারাবাস ছিল তাঁর জন্য এক অন্তর্গত নির্বাসন।
বেনজির ভুট্টো সামরিক শাসনের চাপে পাকিস্তান ছাড়তে বাধ্য হন। নির্বাসন থেকেই তিনি গণতন্ত্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক জনমত গড়ে তোলেন এবং দেশে ফিরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হন—যদিও তাঁর জীবন শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হয়।
এসব উদাহরণ এ কথাই বলে যে নির্বাসন নেতৃত্বকে নিঃশেষ করে না; বরং সঠিক ক্ষেত্রে তা নেতৃত্বকে গভীরতর করে।
তারেক রহমান: নির্বাসনের ভেতর দিয়ে গড়া রাজনীতি
তারেক রহমানের ১৭ বছরের নির্বাসনকেও এই ঐতিহাসিক ধারার ভেতরে রাখা যেতে পারে। এই সময় তিনি কেবল দেশ থেকে দূরে ছিলেন—রাজনীতি থেকে নয়; বরং দূরত্ব তাঁকে দেশের বাস্তবতা নতুনভাবে অনুধাবনের সুযোগ দিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার দমন, বিরোধী রাজনীতির শূন্যতা, প্রশাসনিক একমুখীনতা—সবকিছুর নিরীক্ষা তিনি করেছেন নির্বাসনের সময় থেকে।
তারেক রহমান বুঝতে পেরেছেন রাষ্ট্রক্ষমতার নৈতিক সংকট, সংগঠন ও কাঠামোর গুরুত্ব। উপলব্ধি করেছেন দূর থেকেও একটি জাতির আকাঙ্ক্ষা ধারণ করা যায়। তাই তাঁর রাজনৈতিক সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগত প্রতিকূলতার কাহিনি নয়। মামলা, নির্যাতন ও নির্বাসনের মধ্য দিয়ে তিনি যে রাজনৈতিক পাঠ নিয়েছেন, তার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়া যায় বিএনপির ঘোষিত ৩১ দফা কর্মসূচিতে। এটি একটি রাষ্ট্রদর্শন—যেখানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, জবাবদিহি ও সামাজিক ন্যায়বিচার একসূত্রে গাঁথা।
প্রত্যাবর্তনের রাজনীতি: ক্ষমতার চেয়েও বড় এক নৈতিক মুহূর্ত
ইতিহাসে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রত্যাবর্তন কখনোই নিছক ভৌগোলিক ঘটনা নয়। নির্বাসনের পর প্রত্যাবর্তন মানে শুধু ঘরে ফেরা নয়—এটি ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানো। জনমানসের সঙ্গে নতুন করে সংলাপে প্রবেশ করা।
প্রত্যাবর্তনের রাজনীতি তাই ক্ষমতার রাজনীতির চেয়েও গভীর। ক্ষমতা দখল করা যায় কৌশলে; কিন্তু প্রত্যাবর্তন ঘটে আস্থা ও বিশ্বাসে। বিশ্ব-ইতিহাসে যেসব প্রত্যাবর্তন স্মরণীয় হয়ে আছে, সেগুলো কোনো বিজয় মিছিলের কারণে নয়; বরং সেগুলো জাতির মানসিক কাঠামো বদলে দিয়েছিল বলেই স্মরণীয়।
বাংলাদেশ আজ ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে প্রত্যাবর্তনের রাজনীতি নতুন করে অর্থবহ হয়ে উঠেছে। দীর্ঘ সময় ধরে রাষ্ট্রক্ষমতার একমুখী দখল, বিরোধী কণ্ঠের দমন, প্রতিষ্ঠানগুলোর অবক্ষয়—সব মিলিয়ে রাষ্ট্র যেন পথ হারিয়ে ফেলেছে।
এই বাস্তবতায় তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন কেবল একটি রাজনৈতিক ঘটনা নয়। এটি একটি শূন্যতার জবাব। এই শূন্যতা শুধু নেতৃত্বের নয়; এটি ভারসাম্যের, সহনশীলতার শূন্যতা। দীর্ঘ নির্বাসনের মধ্য দিয়ে তারেক রহমান যে রাজনীতি শিখেছেন, তা এই শূন্যতাকে বোঝার রাজনীতি। কারণ, নির্বাসন মানুষকে তাড়াহুড়ো করতে শেখায় না; এটি মানুষকে অপেক্ষা করতে শেখায়। অপেক্ষার ভেতর দিয়েই জন্ম নেয় পরিমিতি, ধৈর্য ও দূরদর্শিতা।
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন তাই ক্ষমতার তাড়নায় নয়, বরং দায়িত্বের তাগিদে। তাঁর সামনে কোনো বিজয়োল্লাসের সহজ পথ নেই। আছে রাষ্ট্রকে পুনর্গঠনের কঠিন দায়িত্ব।
প্রত্যাবর্তন ও পুনর্মিলনের প্রশ্ন
ইতিহাস বলে, নির্বাসন থেকে ফেরা নেতারা দুটি পথের একটিতে হাঁটেন। কেউ প্রতিশোধের রাজনীতি বেছে নেন এবং ইতিহাসে ক্ষণস্থায়ী হয়ে যান। আর কেউ পুনর্মিলনের রাজনীতি বেছে নেন এবং রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী রূপকার হন।
নেলসন ম্যান্ডেলা সবচেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি ২৭ বছরের কারাবাসের পর চাইলে প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি বেছে নিয়েছিলেন পুনর্মিলন। সেই সিদ্ধান্তই দক্ষিণ আফ্রিকাকে গৃহযুদ্ধ থেকে রক্ষা করেছিল।
বাংলাদেশের জন্যও আজ এই প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের পর রাজনীতি কোন পথে যাবে? দীর্ঘ নির্বাসনকালীন তাঁর রাজনৈতিক বক্তব্য, সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত এবং ৩১ দফা কর্মসূচি ইঙ্গিত দেয়—তিনি প্রতিশোধের নয়, প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠনের ভাষায় কথা বলতে চান।
গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার, প্রশাসনিক জবাবদিহি, এসবই প্রত্যাবর্তনের রাজনীতিকে ভবিষ্যৎমুখী করে তোলে। সবশেষে একটি সত্য মনে রাখতে হয়—প্রত্যাবর্তন কোনো সমাপ্তি নয়। এটি আসলে সবচেয়ে কঠিন অধ্যায়ের শুরু। নির্বাসনে থাকা অবস্থায় নেতা প্রতীকে পরিণত হন; প্রত্যাবর্তনের পর তাঁকে প্রমাণ দিতে হয় বাস্তবে। এই পরীক্ষাই এখন সামনে।
তারেক রহমানের দেশে ফেরা ইতিহাসের দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রশ্ন—নির্বাসনের রাজনীতি কি এবার প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে নতুন করে কল্পনা করার সাহস দেবে?
এই প্রশ্নের উত্তর এখনো লেখা হয়নি। কিন্তু ইতিহাস বলে, যে প্রত্যাবর্তন সময়ের দাবিতে ঘটে, তা কখনোই অর্থহীন হয় না।
জুবায়ের বাবু: নির্মাতা ও সম্প্রচারক এবং তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী।
*মতামত লেখকের নিজস্ব