নির্বাচনকে নিয়ে দুয়েকটি পক্ষ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে: সালাহউদ্দিন আহমদ
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছে, সবার মধ্যে ঐক্য ফাটলের একটা চেষ্টা কোনো না কোনো পক্ষ নিচ্ছে বলে আমার মনে হয়। যার জন্য আমরা তর্ক করছি, বিতর্ক করছি, সংস্কারের জন্য আলাপ-আলোচনা করছি। কিন্তু নির্বাচনকে নিয়ে যেন দুয়েকটি পক্ষ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে।’
শুক্রবার সন্ধ্যায় আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ‘রাষ্ট্রীয় মদদে মানবতাবিরোধী অপরাধের কৌশল উন্মোচন’ শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে সালাহউদ্দিন আহমদ এ কথাগুলো বলেন। গুম হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এ সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘কোনো কোনো রাজনৈতিক দল বলছে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের যে রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে, তাতে নাকি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথে বাধা সৃষ্টি হবে। অথবা নির্বাচন ভন্ডুলের নাকি পাঁয়তারা হবে। আমরা সেভাবে কেন দেখব?’
বিএনপি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার জন্য এক বছর ধরে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষি করেছে উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘যখন নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা হয়ে গেল, সেটি জাতির প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে বলে আমরা আমাদের প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছি। সেই জায়গায় এটিকে স্বাগত না জানিয়ে এর মধ্যে কোনো সন্দেহ, দোদুল্যমানতা দেখানো ঠিক হবে না।’ তিনি কোনো বিষয়ে সংশয় থাকলে আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেন।
নির্বাচনে ভোটাধিকার দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, এই ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য দেশের মানুষ ১৬ বছর সংগ্রাম করেছে, রক্ত দিয়েছে। সেই ভোটাধিকারের একটি রাস্তা যখন সুগম হয়েছে, সেই রাস্তায় যেন কোনো কাঁটা বিছানো না হয়।
রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কারের জন্য গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছে উল্লেখ করে বিএনপির এই নেতা বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে।
ক্ষমতায় গেলে গুম প্রতিরোধে আইন করে সেটি কার্যকর করা হবে
সালাহউদ্দিন আহমদ অভিযোগ করেন, আজীবন ক্ষমতায় থাকার লক্ষ্যেই আওয়ামী লীগ সরকার গুমের মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, তারা এখনো নিজেদের অপরাধ স্বীকার করেনি, উল্টো গণ-অভ্যুত্থনকারীদের অপরাধী হিসেবে নামকরণ করছে। সেমিনারে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান লিটনের দেওয়া একটি তথ্য উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১ হাজার ৮৫০ জন গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৩৫০ জন এখনো ফেরত আসেননি। বিএনপি চাইছে, আর কোনো মা-বাবাকে ছবি হাতে নিয়ে সন্তান খুঁজতে রাস্তায় দাঁড়াতে না হয়।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, জনগণ ম্যান্ডেট দিলে বিএনপি ক্ষমতায় এসে প্রথমেই গুম প্রতিরোধ করার জন্য, এই সংস্কৃতি নিশ্চিহ্ন করার জন্য আইন প্রণয়ন করে সেটি কার্যকর করার জন্য সবকিছু করা হবে। গুমের শিকার হয়ে কোনো ব্যক্তিকে রাস্তায় দাঁড়াতে হবে না, বিএনপি এমন বাংলাদেশ বিনির্মাণের চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমদ।
যে দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা শতভাগ নিশ্চিত করা যাবে, সে দেশে গণতন্ত্র শক্তিশালী থাকবে বলে উল্লেখ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই নেতা। সাংবাদিকদের তিনি মালিকদের কাছে দায়বদ্ধ না থেকে বিবেকের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা বলেন। সাংবাদিকদের যেসব আইনি সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী ভবিষ্যতে আইন প্রণীত হবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন সালাহউদ্দিন আহমদ।
সেমিনারে আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী সারা হোসেন বলেন, গুম প্রতিরোধে নতুন যে আইন হচ্ছে, সেটির মাধ্যমে বিচারের যতগুলো দিক আছে, সেগুলো চাওয়ার পথ তৈরি হবে। পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার কথা থাকবে। তবে আইনটি কার্যকর হতে হবে, যাতে আইনের ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। এই আইন প্রণয়নের আগে গুমের শিকার পরিবারের বক্তব্য যাতে স্পষ্ট থাকে। অধ্যাদেশ হিসেবে জারির আগে পরিবারগুলোর মতামত লাগবে। তিনি বলেন, এই আইনের মাধ্যমে বিচারের নামে যাতে অন্যায়-অবিচার না হয়, সেটিও দেখতে হবে। গুমের শিকার পরিবারগুলোকে প্রতিকার চাওয়ার পাশাপাশি নিজেদের পরিবর্তনের চাকা হতে হবে।
গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের সদস্য নূর খান বলেন, গুম কমিশন গঠন হওয়ার পর এখন পর্যন্ত কমিশনে ১ হাজার ৮০০–এর বেশি অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগ যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। অনুসন্ধানের কাজও চলমান। তিনি বলেন, গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে যাঁরা জড়িত, যাঁরা গুমের নির্দেশ দিতেন, তাঁদের অনেকেই এখনো আগের জায়গাগুলোতেই অবস্থান করছেন। এ অবস্থায় কমিশনের কাজ চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর। কেন একটি বাহিনীর ভেতরে আরেকটি চক্র গড়ে উঠে তারা স্বাধীনভাবে কাজ করে, সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন নূর খান।
সেমিনারের মধ্যভাগে একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়। এটি সঞ্চালনা করেন মায়ের ডাকের সংগঠক সানজিদা ইসলাম।
সেমিনারে বক্তব্য দেন জাতিসংঘের আবাসিক অফিসের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকার উপদেষ্টা হুমা খান, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের উপদেষ্টা মাহদী আমিন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তানিয়া রব।
গুমের শিকার বিএনপি নেতা এম ইলিয়াস আলীর স্ত্রী তাহসিনা রুশদীর, বিএনপির সহ-গণশিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান তালুকদার, এবি পার্টির সহকারী সদস্যসচিব নাসরীন সুলতানা, সাবেক সেনা কর্মকর্তা হাসিনুর রহমান, গুমের শিকার হওয়া ইউপিডিএফের রাজনৈতিক সংগঠক মাইকেল চাকমা, অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট সাইয়্যেদ আবদুল্লাহ, এনসিপির দপ্তর সম্পাদক সালেহ উদ্দিন সিফাতসহ গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরাও সেমিনারে বক্তব্য দেন।