সরকারের সঙ্গে থাকতে চায় জাপার একটি অংশ, অন্যটি দ্বিধাগ্রস্ত

রওশন এরশাদ ও জিএম কাদের
ফাইল ছবি

আগামী জাতীয় নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গেই থাকতে চান সংসদে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টির (জাপা) বেশির ভাগ সংসদ সদস্য। তবে দলের শীর্ষ নেতৃত্বসহ একটি অংশ সরকারের সঙ্গে এবার গাঁটছড়া বাঁধতে আগ্রহী নয়। তারা রাজনীতিতে একটা ‘স্বতন্ত্র’ অবস্থান নেওয়ার পক্ষে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে অবস্থান স্পষ্ট করতে না পারায় এ অংশটি দ্বিধাগ্রস্ত।

জাপার দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, একটি অংশের সরকারের সঙ্গে থাকার, অন্য অংশটির স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়ার তৎপরতা দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ধোঁয়াশা তৈরি করেছে।

তাঁরা এখনো বুঝতে পারছেন না, আগামী নির্বাচনে জাপার ভূমিকা কী হবে। কারণ, প্রকাশ্যে না হলেও ভেতরে-ভেতরে দলের অভ্যন্তরে দুটি ধারা স্পষ্ট। একটি ধারা দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের নেতৃত্বে, অন্যটি দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদকে ঘিরে। যে অংশটি সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়, তারা গোপনে রওশনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে।

‘আমি মনে করি, জাতির এই ক্রান্তিকালে জাতীয় পার্টির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, আবার বেশ কিছু পথও খোলা আছে। উপায়গুলো এই মুহূর্তে পরিষ্কার করা যাবে না। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী উপায়গুলো বেছে নিতে হবে। তবে সে উপায়গুলো নিতে একটু সময় নিতে হবে।’
কাজী ফিরোজ রশীদ, জাপার কো-চেয়ারম্যান

যদিও রওশন এরশাদের প্রকাশ্য কোনো তৎপরতা নেই। তিনি বার্ধক্যসহ নানা জটিলতায় শারীরিকভাবে অসুস্থ। প্রায় এক মাস থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে চিকিৎসা শেষে গতকাল মঙ্গলবার তিনি দেশে ফিরেছেন। নির্বাচন এলেই রওশন সক্রিয় হন। তিনি প্রকাশ্যে বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেছেন। একই সঙ্গে সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণেরও আগাম ঘোষণা দিয়েছেন।

জাপার নেতারা বলছেন, এখানেই রওশন এরশাদের সঙ্গে জি এম কাদেরের মতবিরোধ। নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু দিন ধরে জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব রাজনীতিতে একটা স্বতন্ত্র অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা করছেন। সে লক্ষ্যে জাপার দুই শীর্ষ নেতা জি এম কাদের ও মো. মুজিবুল হক রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের ভুলত্রুটি ধরে কঠোর সমালোচনা করে আসছেন। কিন্তু দলের ভেতর থেকে বিপরীতমুখী তৎপরতায় এখন পর্যন্ত স্বতন্ত্র অবস্থান স্পষ্ট করতে পারছেন না শীর্ষ নেতৃত্ব। এ ক্ষেত্রে দলে ভাঙনের আশঙ্কা করছেন অনেকে।

এ বিষয়ে দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে তাঁদের অনেকে বলছেন, জাপার নেতৃত্ব নিয়ে ‘মামলা-মোকদ্দমা’ দিয়ে এমনিতেই বিরোধ বাধিয়ে রাখা হয়েছে। জি এম কাদের যদি সরকারবিরোধী কোনো তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত হন, তাহলে রওশন এরশাদকে দিয়ে দলে ভাঙন তৈরি করা হবে। এ কারণে তিনি বেশি দূর এগোতে পারছেন না।

জাতীয় পার্টি এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। সময় এলে, অবস্থা বুঝে, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তিনি এ-ও বলেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোনো জোটে যাবে কি না বা নির্বাচন কীভাবে করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মো. মুজিবুল হক, জাপার মহাসচিব

জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, জাতির এই ক্রান্তিকালে জাতীয় পার্টির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে, আবার বেশ কিছু পথও খোলা আছে। উপায়গুলো এই মুহূর্তে পরিষ্কার করা যাবে না। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী উপায়গুলো বেছে নিতে হবে। তবে সে উপায়গুলো নিতে একটু সময় নিতে হবে।’

তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, কার্যত দলের বেশির ভাগ নেতা ও সংসদ সদস্য সুযোগসন্ধানী। তাঁরা যে দিকে সুবিধা পাবেন, সে দিকেই থাকবেন। এ কারণে দলের বড় একটি অংশ প্রকাশ্যে জি এম কাদেরের নেতৃত্বের প্রতি আস্থাশীল দেখালেও যে অংশটি সরকারের সঙ্গে থাকতে চায়, তারা রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে। কারণ, রওশন এরশাদ সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে বেশি আস্থাশীল।

এ বিষয়ে জাপার একাধিক সংসদ সদস্যের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তাঁরা বলেছেন, তাঁদের ধারণা আওয়ামী লীগ আবারও যেকোনো উপায়ে ক্ষমতায় আসবে। তাই আবার সংসদ সদস্য হতে হলে সরকারের সঙ্গে সখ্য রেখে চলাই ভালো। তা না হলে রাজনীতিতে জাপার যে অবস্থান আছে, সেটিও হারাবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জাপার একজন নারী সংসদ সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারের সঙ্গে এত দিন ছিলাম। এখনো বের হয়ে যাইনি। সবাই চাচ্ছে সরকারের সঙ্গে থাকতে।’

সর্বশেষ গত শনিবার জাপার প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথ সভায় একাধিক সংসদ সদস্য সরকারের সঙ্গে থাকার পক্ষে মত দেন। জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ৩৭ জন প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্য অংশ নেন। সভায় জি এম কাদের আবারও স্পষ্ট করেন, জাতীয় পার্টি নিজস্ব স্বকীয়তা ও আদর্শ নিয়ে রাজনীতি করবে। কারও ‘বি টিম’ হয়ে রাজনীতি করবে না।

অবশ্য জাপার মহাসচিব মো. মুজিবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, জাতীয় পার্টি এখনই কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। সময় এলে, অবস্থা বুঝে, জনগণের চাহিদা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবে। তবে তিনি এ-ও বলেন, আগামী নির্বাচনে জাতীয় পার্টি কোনো জোটে যাবে কি না বা নির্বাচন কীভাবে করবে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।