তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন, সেদিন মনে ছিল না: ফখরুল

বিএনপির সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। আজ বুধবার রাজধানীর নয়াপল্টনে
ছবি: সাজিদ হোসেন

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিন হরতাল ডাকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘সেদিন মনে ছিল না যে ১৭৩ দিন হরতাল করেছিলেন, যে সিস্টেমটা চালু করেছিলেন, এটা আবার তোমার ওপরেই আসতে পারে।’ বুধবার বিকেলে রাজধানীর নয়াপল্টনে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি গণতন্ত্র হত্যা করে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল প্রতিষ্ঠার প্রতিবাদে এক বিক্ষোভ সমাবেশে তিনি এ কথা বলেন।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কেয়ারটেকার সরকার আমরা চাই নাই। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছিলেন, এটা চলবে না, এটা গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না। কিন্তু সেই দিন এই আওয়ামী লীগ ১৭৩ দিন হরতাল করে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টিকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলন করে।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘এই সরকার অত্যন্ত সচেতনভাবে আমাদের অধিকারগুলো কেড়ে নিয়েছে। আমাদের একটি ছদ্মবেশী একদলীয় বাকশাল দিয়েছে। যার ফলে আজকে আবারও নির্বাচনের তামাশা তৈরি করে তারা আবার নির্বাচন নাটক করতে চায়। আপনারা তাদের সে নির্বাচন করতে দেবেন?, সেই নির্বাচন এ দেশে হবে? হবে না।’

আওয়ামী লীগ দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতিকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আজকে আওয়ামী লীগের অনির্বাচিত সরকার, যারা জনগণ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, এরা আমাদের সমস্ত সংস্কৃতিকে ধ্বংস করছে। আমাদের চিন্তাভাবনাগুলোকে ধ্বংস করছে। এতকাল যেসব মূল্যবোধ নিয়েছিলাম, সে মূল্যবোধগুলোকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। পত্রপত্রিকায় নিশ্চয়ই দেখেছেন পাঠ্যবই নিয়ে।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘পাঠ্যবইয়ে কী আছে। যেগুলো আমাদের চিন্তার বাইরে সে সমস্ত জিনিস তারা আনছে। আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে যেগুলো মেলে না, সেগুলোকে তারা নিয়ে এসেছে। আমাদের ঐতিহ্য, কৃষ্টি আমাদের জীবনবোধ, ধর্মবোধ, সেগুলোকে তারা নিয়েছে যাতে করে সমাজে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি হয়। সে জন্য আমরা পরিষ্কার করে বলেছি, এই পাঠ্যবই যেগুলো ঐতিহ্য কৃষ্টি এবং জাতির সঙ্গে মেলে না সেগুলো বাতিল করতে হবে।’

আরও পড়ুন
রাজধানীর নয়াপল্টনে দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সমাবেশে উপস্থিত দলের কেন্দ্রীয় নেতারা
ছবি: প্রথম আলো

‘রাষ্ট্রপতি কি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন?’

সমাবেশে মির্জা ফখরুল ইসলাম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হবে সামনে। ১৯ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। কোন রাষ্ট্রপতি, যে রাষ্ট্রপতির কোনো ক্ষমতা নেই সেই রাষ্ট্রপতি? আমরা রাষ্ট্রপতির আসনটাকে খুব সম্মান করি। যে–ই থাক, যে দলেরই হোক, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান—শিরোধার্য। সেই রাষ্ট্রপতি কি তাঁর দায়িত্ব পালন করতে পারেন? তিনি কি আওয়ামী লীগের, যিনি অবৈধ প্রধানমন্ত্রী, তাঁর কথার বাইরে একটা কাজ করতে পারেন? তিনি কি নির্বাচন কমিশন পরিবর্তন করতে পারেন? তিনি কি একটা আইন পরিবর্তন করতে পারেন? পারেন না। সেই কারণে আমরা ২৭ দফার মধ্যে পরিষ্কার করে বলেছি, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনতে হবে।’

‘ভয়ে পাল্টা কর্মসূচি’

কিছুদিন ধরে আওয়ামী লীগের বিএনপির পাল্টা কর্মসূচি দেওয়ার প্রসঙ্গ তোলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘একটা জিনিস লক্ষ করছেন আপনারা, আমরা যখনই কোনো কর্মসূচি দিই, তখনই আওয়ামী লীগ একটা পাল্টা কর্মসূচি দেয়। এখনো একটা কর্মসূচি চলছে ওদের অফিসের সামনে। এত আস্থার অভাব নিজেদের ওপরে, এত ভয় যে বিএনপি কর্মসূচি করলে না জানি কী হয়ে যাবে। ওই ভয়ে কর্মসূচি দিয়ে বসে থাকে।’

আওয়ামী লীগ দেশের গণতন্ত্র হত্যা করেছে, প্রতিদিন তারা জাতির স্বপ্নগুলোকে হত্যা করে চলেছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘এরা (আওয়ামী লীগ) এমনি যায় না। এদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরাতে হবে। আমরা আন্দোলন শুরু করেছি। আন্দোলন চলতেই থাকবে যতক্ষণ পর্যন্ত না এই আওয়ামী লীগ সরছে।’

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রতিটি জাতি নিজেই তার নিজের ভাগ্য তৈরি করে। আমরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম, ৯০–এ ছাত্ররা স্বৈরাচারের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করে এনেছিল। আজ আমাদের ওপরে সে পবিত্র দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে। লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই ভয়াবহ দানবকে (সরকার) বিদায় করে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এদের সরাতে হবে, বিদায় করতে হবে।’

আরও পড়ুন
বিএনপির বিক্ষোভ সমাবেশে রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতা–কর্মীরা অংশ নেন
ছবি: প্রথম আলো

আজরাইলের গল্প

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে বিএনপির ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম এ সরকারের সময় শেষ বলে মন্তব্য করেন। পরে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘একটা গল্প বলব। এক মানুষ জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়ে, আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি আত্মহত্যা করতে নদীর পাড়ে গিয়ে উঁচু জায়গায় যান। যেই লাফ দিতে গেছেন, পেছন থেকে আজরাইল কলার ধরে টান দিয়েছেন। আজরাইল বললেন, মরতে পারবে না, তোমার সময় হয়নি।

আজরাইল বললেন, তোমাকে বুদ্ধি দিই, তুমি গ্রামে ফিরে গিয়ে ডাক্তারি শুরু করো। লোকটি বললেন, আমি তো ডাক্তারি জানি না। আজরাইল বললেন, তোমার কিছুই করতে হবে না। যখন রোগী দেখতে যাবে, তখন দেখবে রোগীর কোন দিকে আমি দাঁড়িয়ে আছি। যদি দেখো মাথার দিকে দাঁড়িয়ে আছি, তাহলে বলে দেবে ওই রোগী আর বাঁচবে না। আর যদি দেখো আমি পায়ের দিকে দাঁড়িয়ে আছি, তাহলে তুমি যে ওষুধই দাও সে বেঁচে উঠবে।’

আরও পড়ুন

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘লোকটি বাসায় গিয়ে নেমপ্লেট লাগিয়ে দিল ডাক্তারির। রোগী দেখতে যায়, যাকে বলে সে বাঁচবে সে বেঁচে যায়। যাকে বলে মরবে, সে মরে যায়।

কিছুদিনের মধ্যে তাঁর দারুণ প্রসার হয়ে গেল, তাঁর অনেক পয়সা হলো, বাড়ি করল, গাড়ি করল। কয়েক বছর পরে রাত্রিবেলায় সে খেয়েদেয়ে আয়েশ করে পান চিবুতে চিবুতে শুয়ে পড়েন। হঠাৎ করে তন্দ্রার মধ্যে দেখেন মাথার কাছে আজরাইল। যেই দেখল আজরাইল, লোকটি সালাম দিয়ে ভন করে পা ঘুরিয়ে দিল। কিন্তু চোখের পলকে দেখে আজরাইল আবারও তাঁর মাথার কাছে। এরপর লোকটি ভন ভন করে বিছানায় ঘুরতে শুরু করেছে। এবার আজরাইল বলে তুমি এভাবে ঘুরছ কেন? লোকটি বলে আমি তো ভালো আছি, আমি মরতে চাই না। আজরাইল বললেন, না। ভালো থেকে লাভ নেই। তোমার সময় হয়ে গেছে। এবার যেতে হবে।’

এই গল্পের অবতারণা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম সরকারের উদ্দেশে বলেন, ‘এদের সময় হয়ে গেছে। এবার এদের যেতে হবে। যারা আমার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে, যারা গুম করেছে আমাদের ভাইদের। অসংখ্য নেতা-কর্মীদের যারা আহত করেছে, অত্যাচার-নির্যাতন করেছে। তাদের এই ঋণ শোধ করার জন্য অবশ্যই যেতে হবে।’

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এ দেশের মানুষ বাকশাল মানেনি, বাকশালকে পদদলিত করেছে। জিয়াউর রহমান বাকশালকে কবর দিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগও এই জিয়াউর রহমানের সময়ে রাজনৈতিক দল হিসেবে আবার যাত্রা শুরু করে।

দলের স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, বাংলাদেশের মানুষ কখনো দাসত্ব মানে না। বাকশালের একদলীয় দাসত্বও মানবে না। তিনি বলেন, ‘ইনশাআল্লাহ আমরা গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করব, খালেদা জিয়াকে মুক্ত করব।

আন্দোলনে আছি, আন্দোলনে থাকব, এই সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে।’
সমাবেশে আরও বক্তব্য দেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু, ঢাকা মহানগর বিএনপির উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, প্রচার সম্পাদক শহীদউদ্দীন চৌধুরী, বিএনপি নেতা খায়রুল কবির, ফজলুল হক, নাজিম উদ্দিন আলম, তাবিথ আউয়াল ও ইশরাক হোসেন প্রমুখ।