সরু গলির শেষ মাথায় পুরোনো ও জংধরা টিনের কয়েকটি ঘর। প্রতিটি ঘর এক কক্ষের। খেটে খাওয়া মানুষ অল্প টাকায় এসব ঘর (ছাপরা হিসেবে পরিচিত) ভাড়া নিয়ে সংসার পেতেছেন। এর মধ্যে একটি ঘর অবশ্য ব্যতিক্রম। সেখানে কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলেছে নিবন্ধনের জন্য নির্বাচন কমিশনের প্রাথমিক বাছাইয়ে যোগ্য বিবেচিত হওয়া ২২টি দলের মধ্যে অন্যতম জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ)।
রাজধানীর কল্যাণপুরের ১৩ নম্বর সড়কে ওই টিনের ঘর থেকেই রাজনৈতিক কার্যক্রম চালাচ্ছে দলটি। নিবন্ধনের যোগ্য বিবেচিত হওয়া আরেকটি দল ‘বাংলাদেশ সলুশন পার্টি’। তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় গাজীপুরের কাপাসিয়ার গ্রামে পোশাক তৈরির একটি ছোট কারখানায়। এই কারখানা অবশ্য এখন বন্ধ আছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস) তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে যে ঠিকানা দিয়েছে, সেটি আসলে দলটির সভাপতির ছেলের বাসা।
যোগ্য বিবেচিত হওয়া ২২টি দলের বিষয়ে ২৩ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত তিন দিন সরেজমিনে তথ্য সংগ্রহ করেছে প্রথম আলো। এই দলগুলো কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের যে ঠিকানা নির্বাচন কমিশনে (ইসি) জমা দেওয়া নিবন্ধন আবেদনে উল্লেখ করেছে, তার প্রতিটি পরিদর্শন করেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ১৯টি দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় রাজধানী ঢাকায়। বাকি তিনটি দলের কার্যালয় সাভার, কেরানীগঞ্জ ও গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। দলগুলোর কার্যালয় পরিদর্শন, নেতাদের বক্তব্য নেওয়া ও তথ্য সংগ্রহের কাজে যুক্ত ছিলেন প্রথম আলোর তিনজন প্রতিবেদক ও দুজন প্রতিনিধি।
অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা চিন্তা করে নিবন্ধন পেলে এটাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা যাবে। কোনো বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করে সংসদ সদস্য হওয়া যাবে। সংসদ সদস্য হতে পারা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ব্যবসা।আবদুল আলীম, সদস্য, সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন
নিবন্ধন আবেদনে ২২টি দল যে ঠিকানা দিয়েছে, তার মধ্যে ৪টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় আবাসিক ভবনে বা বাসাবাড়িতে। এ ৪টি দল হলো বাংলাদেশ বেকার সমাজ, বাংলাদেশ জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) এবং জনতার দল।
২টি দলের দেওয়া ঠিকানায় গিয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে নতুন বাংলাদেশ পার্টি মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার যে ঠিকানা নিবন্ধন আবেদনে উল্লেখ করেছে, সেই ভবনের কেউ দলটির কথা জানেন না। পরে দলটির চেয়ারম্যান মেজর (অব.) সিকদার আনিসুর রহমানের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মালিবাগের কার্যালয় নেওয়া হয়েছিল দলের এক কর্মীর মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলের কার্যালয় হিসেবে ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি ভবনমালিককে জানানো হয়নি। এ নিয়ে ভবনমালিক আপত্তি তুললে সেখান থেকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ইসিবি চত্বরের একটি ভবনে স্থানান্তর করেছেন। বিষয়টি চিঠি দিয়ে ইসিকে অবহিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা লিখেছে টানপাড়া আটি, কেরানীগঞ্জ। সরেজমিনে কেরানীগঞ্জের শাক্তা ইউনিয়নের আটি দাড়িপাড়া, আটি বাদশার মোড়, আটি পাঁচদোনা, আটি টেবারগ্রামসহ আশপাশের এলাকায় ঘুরে কোথাও টানপাড়া আটি নামের কোনো এলাকার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, টানপাড়া আটির কথা তাঁরা কখনো শোনেননি।
এ বিষয়ে ২৩ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। তখন তিনি বলেন, কেরানীগঞ্জের ঘাটারচর এলাকার আশপাশে দলীয় কার্যালয় রয়েছে। তবে তিনি সুনির্দিষ্ট ঠিকানা বলতে পারেননি। এরপর তিনি মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।
সর্বশেষ ২৮ আগস্ট রাতে মুঠোফোনে মাহবুবুল আলমের সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে প্রথম আলো। এবার তিনি জানান, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঢাকার মিরপুরের মাজার রোডে স্থানান্তর করা হয়েছে। ইসি সেই কার্যালয় পরিদর্শন করেছে।
নিবন্ধনের জন্য প্রাথমিকভাবে যোগ্য বিবেচিত হওয়া ১২টি দলের কার্যালয় বাণিজ্যিক ভবনে। দলগুলো হচ্ছে ফরওয়ার্ড পার্টি, আমজনতার দল, বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টি (বিআরপি), বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী), জনতা পার্টি বাংলাদেশ, বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-সিপিবি (এম) এবং জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি।
বাকি ৪টি দলের মধ্যে মৌলিক বাংলা দল সাভারের যে ঠিকানা উল্লেখ করেছে, সেখানে গিয়ে দেখা যায়, আধা পাকা একটি কক্ষ। এই কক্ষেই দলের কার্যক্রম চলছে। কার্যালয়ের পাশে একটি বাড়ি, একটু দূরে রিকশার গ্যারেজ ও মুদিদোকান। আর বাকি ২টি দল হলো বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টি (বিজিপি) ও জাতীয় জনতা পার্টি। রাজধানীর ওয়ারীর যে ভবনে জাতীয় জনতা পার্টির কার্যালয়, সেটি তাদের নিজস্ব বলে জানিয়েছেন দলটির নেতারা।
নিবন্ধনের শর্ত
কোনো দল দলীয় প্রতীকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে ইসিতে নিবন্ধিত হতে হয়। রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধনের জন্য এবার ইসিতে আবেদন করেছে ১৪৭টি দল। এর মধ্যে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে উত্তীর্ণ ২২টি দলের বিষয়ে ৩১ আগস্টের মধ্যে মাঠপর্যায়ের তদন্তের কাজ শেষ করবে ইসি। এখন ইসিতে নিবন্ধিত দল আছে ৫০টি। এর বাইরে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রেখেছে ইসি।
কোনো দলকে নিবন্ধন পেতে হলে ইসির বেশ কিছু শর্ত মানতে হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকা, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয় এবং অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হয়।
এ ছাড়া কোনো দলের কেউ অতীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে বা আগের কোনো নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট পেলেও নিবন্ধন পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। প্রধান এসব শর্তের সঙ্গে আরও কিছু নিয়মকানুন মেনে আবেদন করতে হয় দলকে।
২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য ইসিতে ৯৩টি দল আবেদন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিবন্ধন পায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। তখন ইসির এই সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল। ইসির ওই সিদ্ধান্তের পর নিবন্ধন না পাওয়া ১০টি দল সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিল, সরকারের নির্দেশনায় এবং বিভিন্ন এজেন্সির পরামর্শে ‘ভুঁইফোড়’ দুটি দলকে নিবন্ধন দিয়েছে ইসি।
২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ৭৬টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু কোনোটিই অনুমোদন পায়নি।
গ্রামের কারখানায় কার্যালয়
বাংলাদেশ সলুশন পার্টি নিবন্ধন আবেদনে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা দিয়েছে কাপাসিয়া, গাজীপুর। ইসির তালিকায় দলটির কোনো নির্দিষ্ট ঠিকানা উল্লেখ ছিল না।
এই দল সম্পর্কে খোঁজ নিতে ২৩ আগস্ট কাপাসিয়া উপজেলা সদরের কলেজ মোড় এলাকায় যান প্রথম আলোর প্রতিনিধি। কিন্তু স্থানীয় লোকজন এই দল নিয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি। কথায় কথায় একজন জানালেন, তিনি শুনেছেন, সলুশন পার্টি নামে একটি দল করেছেন কাপাসিয়ার দুর্গাপুর ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের এক ব্যবসায়ী। ওই ব্যবসায়ী করোনা মহামারির সময় মাস্ক বিক্রির ব্যবসা করতেন।
ইসির তালিকায় দলটির সভাপতি শামছুল হকের মুঠোফোন নম্বর ছিল। তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে দলের কার্যালয় কোথায়, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন নির্বাচনী অফিসের কাজ নিয়ে ঝামেলায় আছি। দুয়েক দিন পর ছাড়া আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে না।...কাজগুলো গোছাচ্ছি। দৌড়ের ওপর আছি, ভাই।’
পরে দুর্গাপুর গ্রামে গিয়ে শামছুল হকের বাবা আবদুল মোতালেবের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, পার্টির কাজে তাঁর ছেলে ব্যস্ত। পার্টির কার্যালয় কোনটি, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁদের বাড়ির পাশে ছেলের একটি কারখানা (পোশাক তৈরি হয়) আছে। আধা পাকা ৪ কক্ষের সেই কারখানা পার্টির কার্যালয়।
ছেলের বাসায় চলে দলের কার্যক্রম
রাজধানীর ক্রিসেন্ট রোডের ‘১৩১/১, এ’ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলায় একটি ফ্ল্যাটের ড্রয়িংরুম বাংলাদেশ বেকার সমাজের (বাবেস) কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. হাসানের ছেলে এই ফ্ল্যাটে থাকেন।
বাবেসের সভাপতি মো. হাসান মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার নিজের বাড়িতে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়। ১০ থেকে ১২ বছর ধরেই এখানে দলের কার্যক্রম চলছে। আমরা ছোট দল। অনেক অসুবিধা আছে। কার্যালয় তো আর ফাঁকা ফেলে রাখা যায় না। তাই সেখানে আমার ছেলে তার পরিবার নিয়ে থাকে।’
কোচিং সেন্টারের ভেতরে
ফরওয়ার্ড পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ধানমন্ডির ২ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। ২৪ আগস্ট দুপুরে ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, ভবনটির প্রবেশমুখের দেয়ালে নীল রঙে দলের একটি পোস্টার সাঁটানো আছে। দ্বিতীয় তলায় স্কলার্স কোচিং সেন্টার। এই কোচিং সেন্টারের ভেতর দিয়ে ফরওয়ার্ড পার্টির কার্যালয়ে যেতে হয়।
ওই কোচিং সেন্টারের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ফরওয়ার্ড পার্টি দুটি কক্ষ ব্যবহার করে। দলটির লোকজন মাঝেমধ্যে আসেন।
ফরওয়ার্ড পার্টির মহাসচিব মো. মাহবুবুল আলম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের শর্ত মেনে সারা দেশে ২২টি জেলা ও ১০০টি উপজেলায় তাঁদের কমিটি রয়েছে।
এক কক্ষের কেন্দ্রীয় কার্যালয়
তোপখানা রোডের বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ ভবনের ষষ্ঠ তলায় বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-সিপিবি (এম)-এর কেন্দ্রীয় কার্যালয়। দলটির কার্যালয় এক কক্ষের। ২৩ আগস্ট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরে ছোট আকারের একটি টেবিল, গোটা দশেক প্লাস্টিকের চেয়ার, একটি হ্যান্ড মাইক ও কিছু রেজিস্টার খাতা রয়েছে। তবে কার্যালয়ে নেই কোনো কম্পিউটার ও প্রিন্টার।
কার্যালয়ে সেদিন মনির নামের এক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি বলেন, দলটির আহ্বায়ক আবদুস সামাদের সঙ্গে চলাফেরা করেন। তবে দলীয় কোনো পদ নেই। দলের বিষয়ে জানার জন্য তালেব ইসলাম নামের একজনের মুঠোফোন নম্বর দেন তিনি। দল সম্পর্কে তিনিই সবকিছু জানেন।
পরবর্তী সময়ে সেই নম্বরে একাধিকবার কল করার পাশাপাশি ও খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
ভাসানী জনশক্তি পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও এক কক্ষের। পুরানা পল্টনের ১১ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় দলটির কার্যালয়ের ভেতরে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একাধিক ছবি রয়েছে। আছে জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছবিও। তবে দলটির শীর্ষ নেতারা এই কক্ষে বসেন না। তাঁরা একই তলার আরেকটি কক্ষে বসেন, যেটি দলটির মহানগর কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই কক্ষ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের চেয়ে পরিচ্ছন্ন।
দলটির মহাসচিব আবু ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, ২০২২ সালে তাঁদের নিবন্ধন আবেদন বাতিল করা হয়। সে কারণে তাঁরা আগের ভাসানী অনুসারী পরিষদ নাম বাদ দিয়ে ভাসানী জনশক্তি পার্টি নাম দিয়ে আবেদন করেছেন। প্রতীক হিসেবে চেয়েছেন ‘তালের আঁশের টুপি’।
টিনের এক কক্ষের ঘরে কার্যক্রম চালানো জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ-শাজাহান সিরাজ) সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের দল থেকে শাজাহান সিরাজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই বিবেচনায় তাঁরা নিবন্ধনের আবেদন করেছেন। প্রতীক হিসেবে ‘দোয়াত কলম’ চেয়েছেন তাঁরা।
অন্যদিকে দলটির সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের শর্তে বাধ্যবাধকতা আছে যে অফিস থাকতে হবে। সেটা পূরণ করেছি। নিবন্ধন পেলে বড় অফিস নেব।’
ছাদে কার্যালয়
পুরান ঢাকার নর্থব্রুক হল রোডে ৫০/৩ নম্বর ভবনের ছাদের একটি কক্ষকে কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামে ইসলাম পার্টি। তবে ভবনের ভেতরে যে একটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয় রয়েছে, তা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই।
২৪ আগস্ট কার্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, কক্ষের ভেতরে কিছু চেয়ার-টেবিল থাকলেও কোনো কম্পিউটার, প্রিন্টার নেই।
দলটির সহকারী মহাসচিব রবিউল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এর আগে নিবন্ধনের জন্য চারবার আবেদন করলেও তাঁদের আবেদন বাতিল করা হয়েছে। দলের কার্যক্রম জানতে চাইলে তিনি মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।
দলটির মহাসচিব মুফতি মোহাম্মদ আবদুল কাইয়ুমের সঙ্গে ২৪ আগস্ট দুপুরে মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, নিবন্ধনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছেন। পরে কথা বলবেন।
এরপর কয়েক দফায় দলটির মহাসচিবের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে একবার হোয়াটসঅ্যাপে তিনি হাতে লেখা একটি কাগজের ছবি তুলে পাঠান। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, কেন্দ্রীয় কমিটি ৫১ সদস্যের। কমিটি পুনর্গঠন হয় ২০২৩ সালের ২৬ আগস্ট। দলের গঠনতন্ত্র এবং জেলা ও উপজেলা কমিটির তথ্য চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।
দলীয় পদের কথা নেতা জানেন না
জনতার দল ঢাকার বাইরে যেসব জায়গায় কমিটি করেছে, তার মধ্যে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলা রয়েছে। দলটির কাছ থেকে সংগ্রহ করা তালিকায় দেখা যায়, দৌলতপুর উপজেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের নাম মোজাফফর দেওয়ান। অথচ দলীয় পদ পাওয়ার বিষয়টি তিনি জানেনই না।
মোজাফফর দেওয়ানের সঙ্গে ২৪ আগস্ট মুঠোফোনে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো রাজনৈতিক দলের লোক নই। একজন অসহায় মানুষ। দিনমজুর হিসেবে কৃষিকাজ করি। মাঝেমধ্যে গান-কবিতা লিখি। অনুদান দেওয়ার কথা বলে মোকছেদ নামের এক ব্যক্তি আমার কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড (জাতীয় পরিচয়পত্র) নিয়েছেন। সেই ব্যক্তিই হয়তো রাজনৈতিক দলের কমিটিতে আমার নাম ঢুকাতে পারেন।’
‘ঢেঁকি’ চায় দুটি দল
সেগুনবাগিচার ৪০/১ নম্বর ভবনের তৃতীয় তলায় বাংলাদেশ সংস্কারবাদী পার্টির (বিআরপি) কেন্দ্রীয় কার্যালয়। কার্যালয়ে ওঠার সিঁড়ি এতটাই সরু যে একসঙ্গে দুজন পাশাপাশি হাঁটতে পারেন না।
তিনটি কক্ষের কার্যালয়ের ভেতরটা অবশ্য পরিচ্ছন্ন। ২৩ আগস্ট কার্যালয়ে কথা হয় দলের ভাইস চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম ও মেহেদী হাসানের সঙ্গে। তাঁরা জানান, ৫৭০ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। দলের প্রতীক হিসেবে ‘ঢেঁকি’ চেয়ে ইসিতে আবেদন করেছেন।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পার্টিও (বিজিপি) দলের প্রতীক হিসেবে ঢেঁকি চেয়ে আবেদন করেছে ইসিতে। এই দলের প্রধান কার্যালয় উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের ৪৭ নম্বর বাসায়। ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, সেটি একটি নির্মাণাধীন ভবন। ভবনটির পার্কিংয়ের এক পাশ সাদা কাপড় দিয়ে ঘেরা কার্যালয়ে ২৩ আগস্ট কথা হয় চেয়ারম্যান এস এম শাহাদাত ও মহাসচিব সাইফুল আলমের সঙ্গে।
এস এম শাহাদাত প্রথম আলোকে বলেন, নির্মাণাধীন ভবনের দোতলায় দলের স্থায়ী কার্যালয় হবে। দোতলার কাজ পুরোপুরি শেষ না হওয়ায় অস্থায়ী ভিত্তিতে পার্কিংয়ে কার্যক্রম চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, বিএনপির সমমনা শরিক দল হিসেবে তাঁরা আছেন। নিবন্ধন পেলে ঢেঁকি প্রতীকে নির্বাচন করতে চান।
কার্যালয়ের দেয়ালে গণ-অভ্যুত্থানের গ্রাফিতি
বাংলামোটরের রূপায়ণ টাওয়ারের ১৬ তলায় জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়। এই কার্যালয়ের দেয়ালে গণ-অভ্যুত্থানের নানা গ্রাফিতি আঁকা। কার্যালয়ের ভেতরের সামনের অংশে সংবাদ সম্মেলন কিংবা সভা করার মতো আধুনিক ব্যবস্থা আছে। দলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের জন্য পৃথক কক্ষ আছে। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বসার জন্য একাধিক কক্ষ আছে।
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটি ২১৬ সদস্যের। ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ জেলায় দলটির কমিটি আছে। মহানগর, উপজেলা ও থানা পর্যায়েও দলটি কমিটি করেছে।
শর্ত পূরণ না করেও কিছু দল নিবন্ধন পেয়েছিল
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের নিয়ম চালু করে ইসি। সাধারণত সংসদ নির্বাচনের আগে দল নিবন্ধনের জন্য ইসি আবেদন আহ্বান করে।
তবে শর্তপূরণ না করেও অতীতে কিছু রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেয়েছিল বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন সাবেক নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুল আলীম। তিনি বলেন, অনেক রাজনৈতিক দল আছে, যারা চিন্তা করে নিবন্ধন পেলে এটাকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করা যাবে। কোনো বড় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট করে সংসদ সদস্য হওয়া যাবে। সংসদ সদস্য হতে পারা এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ব্যবসা। এই ধারণা থেকে ছোট রাজনৈতিক দলগুলো কোনো ধরনের শর্ত পূরণ ছাড়াই রাজনীতিকে বাণিজ্যিক একটা অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এটি বন্ধ করতে হলে রাজনৈতিক দল নিবন্ধন আইনের সংস্কার দরকার।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন শামসুজ্জামান, নিজস্ব প্রতিবেদক, সাভার; ইকবাল হোসেন, প্রতিনিধি, কেরানীগঞ্জ ও সাদিক মৃধা, প্রতিনিধি, শ্রীপুর, গাজীপুর]





