হাসপাতালের সামনে অশ্রুসিক্ত মানুষের ভিড়

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে ভিড়। ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

‘আমি রাজনীতি করি না। কিন্তু খালেদা জিয়াকে দেখে আমরা বড় হয়েছি। তিনি অসুস্থ ছিলেন জানতাম, কিন্তু মৃত্যুর খবর শুনে আর ঘরে থাকতে পারিনি। এখানে এসে মনে হচ্ছে, সবাই আমার মতোই কাঁদছে।’

রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে প্রথম আলোকে কথাগুলো বলছিলেন নাসরিন জাহান। বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবরে রাজধানীর মিরপুর থেকে ছুটে আসেন এই নারী।

খালেদা জিয়া (৭৯) আজ মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর জানাজা আগামীকাল বুধবার বাদ জোহর জাতীয় সংসদের দক্ষিণ প্লাজা ও এর সংলগ্ন মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে অনুষ্ঠিত হবে। তাঁকে তাঁর স্বামী সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পাশে দাফন করা হবে।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া
ছবি: প্রথম আলো

খালেদা জিয়ার মৃত্যুর সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে শোকাহত মানুষ ভিড় করতে থাকেন। বিএনপির নেতা–কর্মী, সমর্থক ও সাধারণ মানুষ—সবাই ছিলেন অশ্রুসিক্ত। হাসপাতাল চত্বর ও আশপাশের এলাকায় তৈরি হয় শোকস্তব্ধ এক পরিবেশ।

সরেজমিনে দেখা যায়, দিনভর হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের কেউ কেউ দল বেঁধে আবার কেউ কেউ বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থান করছেন। কাউকে মোনাজাত করতেও দেখা যায়। একে অন্যের সঙ্গে খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণাও করেন অনেকে।

বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা আরিফ হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি নব্বইয়ের আন্দোলন দেখেছি। ম্যাডাম আমাদের শুধু নেতা ছিলেন না, তিনি ছিলেন সাহস ও অনুপ্রেরণার নাম। তিনি শুধু দলের নেত্রী ছিলেন না, আমাদের কাছে ছিলেন আন্দোলনের শক্তি, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীক।’ কথাগুলো বলার সময় তাঁর চোখ বেয়ে অশ্রু পড়ছিল।

অনেকে এসেছিলেন কালো ব্যাজ পরে। কেউ হাতে ধরে আছেন জাতীয় পতাকা, কেউ খালেদা জিয়ার ছবি, কারও হাতে বিএনপির দলীয় পতাকা। শোকাবহ পরিবেশ। ভিড়ের মধ্যে বারবার কেউ কেউ বলছিলেন, ‘এটা (মৃত্যুর খবর) বিশ্বাস করতে পারছি না।’

দুপুরের দিকে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, সাভার, কেরানীগঞ্জসহ ঢাকার আশপাশের এলাকা থেকে মানুষ আসতে থাকেন। খোরশেদ আলম নামের এক যুবক বলেন, ‘আমি গাজীপুর থেকে এসেছি। কাজ ফেলে চলে এসেছি। মনে হচ্ছিল, না এলে অপরাধ হবে।’

সকাল থেকেই কর্মী–সমর্থদের নিয়ে হাসপাতালের ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজীব পাটওয়ারী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খালেদা জিয়া আমাদের রাজনীতির বড় একটি অধ্যায়। তিনি ছিলেন আপসহীন।’

হাসপাতালে আসা অনেকেই খালেদা জিয়াকে নিয়ে স্মৃতিচারণা করছিলেন। কেউ বলছিলেন আন্দোলনের দিনের কথা, কেউ বলছিলেন কারাবাসের সময় তাঁর দৃঢ়তার গল্প। মধ্যবয়সী শাওন মিয়া বলেন, ‘অনেক নির্যাতন, অসুস্থতা—কিছুই তাঁকে ভাঙতে পারেনি। সেই মানুষটাকে আর দেখতে পাব না, এটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।’

বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালের সামনে ভিড় বাড়তে থাকে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সতর্ক অবস্থানে থাকতে দেখা গেছে। তাঁরা ভিড় নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেন।

রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে শেষবারের মতো দেখতে বিভিন্ন পেশার সঙ্গে যুক্ত ব্যাক্তিরাও হাসপাতালের সামনে এসেছিলেন। কণ্ঠশিল্পী বেবী নাজনীন, মনির খানও এসেছিলেন হাসপাতালের সামনে।

হাসপাতালের আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাধারণ মানুষের মধ্যেও শোকের আবহ স্পষ্ট ছিল। কেউ কেউ বলছিলেন, খালেদা জিয়া কেবল একটি দলের নেত্রী ছিলেন না, তিনি ছিলেন দেশের রাজনীতির প্রতীক। রিকশাচালক আল আমিন বলেন, ‘আমি রাজনীতি অতটা বুঝি না। কিন্তু খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর শুনে বড় মনটা খারাপ হয়ে গেল।’

দিনভর কনকনে শীতের মধ্যেও হাজারো মানুষ হাসপাতালের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের অভিব্যক্তির কথা জানিয়েছেন। সন্ধ্যায়ও হাসপাতালের সামনে ভিড় লেগে ছিল। বাড্ডা এলাকা থেকে আসা এক নারী বলেন, ‘ম্যাডাম নিজের জন্য কিছু করেননি, সব করেছেন দেশের জন্য। ওনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলা হয়েছিল, কিন্তু তিনি যাননি। উনি মারা গেছেন, এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।’