ফেরেশতা, আহাম্মক ও নষ্ট মানুষের রাজনীতি

সরকারের অত্যন্ত প্রভাবশালী তিনজন মন্ত্রী যখন কাছাকাছি সময়ে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে নিজেদের ‘উপলব্ধির’ কথা জানান, সেটি অবশ্যই গুরুত্বের দাবি রাখে। বিশেষ করে টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যখন বিভক্তির রাজনীতি নিয়ে আক্ষেপ করে বলেন, ‘এভাবে গণতন্ত্র বাঁচতে পারে না’ তখন আর কাউকে বলে দিতে হয় না দেশের রাজনীতি আসলে কেমন যাচ্ছে!

একইভাবে দেশের রাজনীতি নিয়ে বিদেশিদের ‘জ্ঞান’ সম্পর্কে নিজের উপলব্ধির কথা যখন প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে দেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন তখন সেটিও বিবেচনায় না নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাঁর উপলব্ধি, ‘এখানে (বাংলাদেশে) প্রত্যেকের হৃদয়ে ডেমোক্রেসি (গণতন্ত্র)। ইলেকশনে (নির্বাচন) যান ৭০ থেকে ৮০ শতাংশের নিচে লোকে ভোট দেয় না। এর চেয়ে বেশি ভোট দেয়। আর যারা আমাদের সুপারিশ দেয়, তাদের দেশে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ লোক ভোট দেয়। তারা কী করে এমন বড় বড় বকবক করে? নিজের দিকে তাকায় না কেন? তাদের দেশে প্রার্থী পাওয়া যায় না নির্বাচনের জন্য। এমন দুরবস্থা। আর আমাদের এখানে একটা কমিশনারের পদের জন্য ১০০ জন লোক নির্বাচন করে। ওরা আসছে আমাদের ...’

খারাপ লোকের হাতে রাজনীতি থাকলে দেশটা খারাপ হবে, খারাপ লোকদের হাতে রাজনীতি থাকলে খারাপ লোকেরা মন্ত্রী হবে, এমপি হবে, দেশ চালাবে, এতে দেশের ভালো হবে না।
ওবায়দুল কাদের, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক
রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে জাতীয় পার্টির (জেপি) ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের। ঢাকা, ৮ জানুয়ারি
ছবি: সংগৃহীত

সমস্যা হলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের উপলব্ধির সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের বেশ পার্থক্য আছে। ওবায়দুল কাদের নিজের উপলব্ধির কথা বলেছেন ঢাকায়, ৮ জানুয়ারি একটি রাজনৈতিক দলের অনুষ্ঠানে। অন্যদিকে আব্দুল মোমেন নিজের উপলব্ধির কথা জানিয়েছেন নিজ জেলা সিলেটে এবং সাংবাদিকদের কাছে (৪ জানুয়ারি)। বাংলাদেশের গণতন্ত্র নিয়ে সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘বিদেশিরা আমাদের যখন মাঝেমধ্যে সুপারিশ দেয়, তখন এগুলো খুব আহাম্মকের মতো মনে হয়।’

দেশের গণতন্ত্র নিয়ে যাদের মধ্যে একটু ‘খচখচানি’ আছে তাঁরা চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এমন সাহসী উপলব্ধির সঙ্গে একমত হতে পারেন। তবে না চাইলেও সমস্যা নেই। কারণ তিনি বলে দিয়েছেন,‘ প্রত্যেকের হৃদয়ে ডেমোক্রেসি’। আর ডেমোক্রেসি বা গণতন্ত্র মানেই তো ভিন্নমত করা বা প্রকাশের সুযোগ। অবশ্য সেই সুযোগ কতটা আছে তা নিয়ে প্রশ্ন বা বিতর্কে না গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে মন্ত্রী কী বলেছেন সেটি আগে জেনে নেওয়া দরকার।

আরও পড়ুন
বিদেশিরা আমাদের যখন মাঝেমধ্যে সুপারিশ দেয়, তখন এগুলো খুব আহাম্মকের মতো মনে হয়।
এ কে আব্দুল মোমেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সিলেট, ৪ জানুয়ারি
ছবি: প্রথম আলো

এবার ৮ জানুয়ারি সেই সিলেটেই এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমেরিকার ৭২ শতাংশ জনগণ মনে করে তাদের দেশের ডেমোক্রেসি খুব দুর্বল। রিপাবলিকান পার্টির ৭৭ শতাংশ মনে করে গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ফ্রড (কারচুপি) ইলেকশন। দ্য হ্যাভ স্টুলেন। এ রকম তাদের মন-মানসিকতা। আমাদের দেশেও কিছু মানুষের মন-মানসিকতা এ রকম। আমাদের অন্যের মাতব্বরি করে পরামর্শ দেওয়ার দরকার নেই। ওনারা নিজেদের আয়নায় দেখুক।’

অবশ্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ৮ জানুয়ারির বক্তব্যে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, সেটি হচ্ছে, নির্বাচনে কারসাজি নিয়ে সন্দেহ করা যুক্তরাষ্ট্রের ‘জ্ঞানের অভাব’।

এখন নিজ নিজ ‘জ্ঞান’ অনুযায়ী চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে যে কেউ দ্বিমত করতে পারেন। অথবা ‘জ্ঞানে সায়’ দিলে একমতও হতে পারেন। কারণ, ‘প্রত্যেকের হৃদয়ে ডেমোক্রেসি’ বা গণতন্ত্র আছে। এ দেশে কেউ ‘ফেরেশতা’ নয়। এটি সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ৭ জানুয়ারি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগ ফেরেশতার দল নয়, মানুষের দল। ভুল-ভ্রান্তি থাকতেই পারে।

ভুল স্বীকার করা কিংবা দায় নেওয়ার প্রবণতা দেশের রাজনীতিতে এখন আর তেমন দেখা যায় না। তবে কেউ সরল স্বীকারোক্তি দিলে কিংবা ব্যর্থতার দায় নিয়ে কিছু বললে, সেটি নতুন কথা না হলেও মানুষ বিবেচনায় নেয়। ব্যর্থতার দায় নিয়ে যখন কেউ বলেন, দেশের রাজনীতি ভালো মানুষের জন্য আকর্ষণীয় করে তোলা যায়নি—সেটি নতুন কথা না হলেও আলোচনার জন্ম দেয়। এই দায় কার কম বা কার বেশি সে তর্কে না গিয়েও বলা যায় ক্ষমতাসীন দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার এমন উপলব্ধি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির জন্য ইতিবাচক।

আরও পড়ুন
স্থানীয় সরকারমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম
ফাইল ছবি

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যে রাজনীতিতে বিরাট কোনো পরিবর্তনের সূচনা হবে এমন আশা করার মতো দুঃসাহসী লোক হয়তো দেশে নেই। এরপরও তাঁর বক্তব্য গুরুত্ব পাচ্ছে, অন্তত সত্যটা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নেওয়ার উদারতা তিনি দেখিয়েছেন।

‘রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসতে চায় না: ওবায়দুল কাদের’ এই শিরোনামে ৮ জানুয়ারি বিকেলে প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রতিবেদন প্রকাশের পর পাঠকেরা যেসব মন্তব্য করেছেন তার কয়েকটি এখানে তুলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে। মো. আরিফুর রহমান নামের এক পাঠক লিখেছেন, ‘তবুও বুঝতে পেরেছেন । প্রায় দেড় দশক ক্ষমতায় আছেন, আপনাদেরই দায় বেশি। ইচ্ছা করলেই অন্য দলদের সঙ্গে নিয়ে ভালো আবহাওয়া তৈরি করতে পারতেন। কিন্তু তা না করে অহেতুক বাগ্‌বিতণ্ডা করে কারণে অকারণে অন্যদের নামে মামলা দিচ্ছেন। এই খারাপ রাজনীতির প্রেক্ষিতে এখন আর কেউই অপরাজনীতিতে আসতে চায় না। আপনারা দেশের কথা না ভেবে পকেটের কথা ভাবেন। যা রেখে যাচ্ছেন তাতে ভালো কিছু হবে না।’

আরেক পাঠক লিখেছেন, ‘গত ১৫-১৬ বছ‌রে একটা সুড়ঙ্গও তৈরি করলেন না ভালো মানু‌ষের রাজনীতিতে আসার। সেটা রাজনী‌তির স্বার্থে না আপনাদের?’

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে একজন পাঠক লিখেছেন, ‘রাজনীতিতে ভালো মানুষ আসবে কী করে? নির্বাচনে আপনারা ছাড়া আর কেউ জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাটুকুও রাখেননি আপনারা’। পাঠকদের মধ্যে আরেকজন লিখেছেন, ‘আপনাদের মতো নেতারাই এর জন্য দায়ী।’

ওবায়দুল কাদের তাঁর বক্তব্যে এক অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে অন্য অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সহজ করে দিতে দেশে একের পর এক সেতু নির্মাণের প্রসঙ্গ তুলে আরও বলেছেন, রাজনীতিতে কোনো সেতু নির্মাণ করা যায়নি, এটাই হচ্ছে বাস্তবতা। রাজনীতিতে বিভেদের দেয়াল দিন দিন উঁচু হওয়া নিয়ে আক্ষেপ করে তিনি আরও বলেছেন, ‘রাজনৈতিক কর্ম সম্পর্কটা আমাদের থাকা উচিত ছিল। এভাবে গণতন্ত্র বাঁচতে পারে না।’

৮ জানুয়ারি জাতীয় পার্টির (জেপি) ত্রিবার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে দেওয়া বক্তব্যে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক দেশে শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকাকে সবচেয়ে বড় দুর্বলতা বলেও উল্লেখ করেছেন। তবে ক্ষমতায় থেকে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করা এবং একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে বিনা ভোটেই সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে গেলে শক্তিশালী বিরোধী দল কীভাবে দেশে থাকবে সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে কোনো ধরনের সমঝোতায় যেতে রাজী না হওয়ার পাশাপাশি হামলা-মামলা-গ্রেপ্তারসহ নানাভাবে দমন নীতি চালালে বিরোধীদের অস্তিত্ব টিকবে কি না, সে বিষয়টিও বক্তব্যে এড়িয়ে গেছেন তিনি।

‘নষ্ট রাজনীতি নষ্ট মানুষের জন্ম দেয়, নষ্ট রাজনীতিকেরা নষ্ট রাজনীতিকে বাঁচিয়ে রাখে। বাংলাদেশের অবস্থা হয়েছে ঠিক তা-ই। এ তো বিভক্তি রাজনীতি!’—এ রকম ভালো-ভালো কথা বললেও এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভূমিকা কী হবে সেটি বক্তব্যে স্পষ্ট করেননি ওবায়দুল কাদের।

শুনতে ভালো লাগে এ রকম আরও অনেক কথা ৮ জানুয়ারির বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন ওবায়দুল কাদের। তাঁর ভাষায়, ‘খারাপ লোকের হাতে রাজনীতি থাকলে দেশটা খারাপ হবে, খারাপ লোকদের হাতে রাজনীতি থাকলে খারাপ লোকেরা মন্ত্রী হবে, এমপি হবে, দেশ চালাবে, এতে দেশের ভালো হবে না । ভালো লোকদের রাজনীতিতে আনতে হবে, মেধাবীদের রাজনীতিতে আনতে হবে, সৎ লোকদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে। না হলে রাজনীতি মেধাশূন্য হয়ে যাবে। চরিত্রবানদের রাজনীতিতে নিয়ে আসতে হবে, না হলে রাজনীতি চরিত্রহীন হয়ে যাবে।’

ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের রেশ ধরে বলা যায়, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধীপক্ষ সমঝোতার ভিত্তিতে দেশের স্বার্থে সমাধানের কোনো একটা পথ খুঁজে নেবে—এমনটা মানুষ আশা করে। সংঘাতের রাজনীতির কারণে সামনে অনিশ্চয়তা আরও বাড়ুক এমনটি কেউ চায় না। মানুষ চায়, নতুন এই বছরে অর্থনীতি স্বাভাবিক গতিতে চলুক, ভালো নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি হোক। মানুষের এটুকু চাওয়া পূরণের দায়িত্ব সরকারসহ দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এই দায়িত্ব কতটা পূরণ করতে পারবে?

ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো