এ সরকারকে হটিয়ে জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠায় একমত বিএনপি-গণ অধিকার পরিষদ

গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টার সংলাপ শেষে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, বর্তমান সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন নয়—সে ব্যাপারে তাঁরা একমত হয়েছেন। সেই সঙ্গে এ সরকারকে সরানোর জন্য যুগপৎভাবে আন্দোলন এবং নির্বাচন-পরবর্তী রাষ্ট্র মেরামতে ‘জাতীয় সরকার’ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও তাঁরা একমত হয়েছেন।

আজ বুধবার বেলা ১১টা থেকে পৌনে একটা পর্যন্ত রাজধানীর পুরানা পল্টনে গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এ সংলাপ হয়।
সংলাপ শেষে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া বলেন, ‘খুব ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে এবং আমরা অনেক ব্যাপারে দেখলাম একমত—এখনকার সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার পর আমরা বুঝেছি যে আমরা একই পথে একই চিন্তায় আছি। এটা একটা খুশির খবর বিরোধী দলের জন্য, যারা বাংলাদেশের একটা পরিবর্তন চায়, তাদের জন্য।’

রেজা কিবরিয়া বলেন, মূল বিষয়টা হলো আমাদের এই সরকারের অধীন নির্বাচনে যাওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই এবং আওয়ামী লীগের অধীন কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, আমরা সেটা মনে করি না। অনেক দলের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে, আরও হবে। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐক্য তৈরি করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। জাতির স্বার্থে গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরা একসঙ্গে কাজ করব।’

এরপর মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি, খুশি হয়েছি যে তারা সব বিষয়ে আমাদের সঙ্গে একই মত ধারণ করে। বিশেষ করে এই সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন নয়, সে ব্যাপার একমত হয়েছে। আমরা এ বিষয়েও একমত হয়েছি যে এ সরকারকে আর ক্ষমতায় থাকতে দেওয়া যায় না।’

এর ব্যাখ্যা করে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘কারণ এই সরকার অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে এবং সচেতনভাবে বাংলাদেশের অর্জিত গণতন্ত্র, বাক্‌স্বাধীনতা, সামাজিক মূল্যবোধ—সব ধ্বংস করে দিয়েছে। এ কারণে এ সরকারকে সরানোর জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে একটা ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে একমত হয়েছি। এই আন্দোলন আমরা যুগপৎভাবে করব।’

আন্দোলন এবং আন্দোলন-পরবর্তী কিছু রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথাও তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, তাঁদের লক্ষ্য যুগপৎ আন্দোলনে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা, সংসদ ভেঙে দেওয়া, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এরপর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা এবং তার মধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা করা— যে সরকার সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করবে।

মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘সেই সরকার গঠনের পর আমরা রাষ্ট্র মেরামতের জন্য সবাইকে নিয়ে জাতীয় সরকারের মতো একটা সরকার গঠন করব।’ এরপর গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নূর বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব যথার্থই বলেছেন যে চলমান সংকটকে আমরা যেভাবে দেখি, তাতে বিএনপির সঙ্গে আমাদের খুব একটা পার্থক্য নেই সংকট উত্তরণে আমাদের করণীয় নিয়ে। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেছি। আজকের আলোচনায় মোটামুটি ১০টি বিষয় ছিল।’

পরে বিএনপির সঙ্গে আলোচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে একটি লিখিত বক্তব্য সাংবাদিকদের দেন। তাতে বলা হয়, দেশের চলমান সংকট থেকে উত্তরণ ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে অন্যান্য গণতন্ত্রকামী দলসমূহের সঙ্গে গণ অধিকার পরিষদ একত্রে বা যুগপৎভাবে কাজ করতে নীতিগতভাবে একমত পোষণ করে। এর মধ্যে ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় যুগপৎ বা ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা।

নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন, ইভিএম বাতিল করে স্বচ্ছ ব্যালট বাক্সে ভোট গ্রহণ, কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্য আনয়নসহ সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার, খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দী ও ধর্মীয় নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি, সব ধরনের কালাকানুন বাতিল, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাসহ জাতীয় স্বার্থে জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

ঐকমত্যের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে নুরুল হক বলেন, ঐকমত্যের সরকার বলতে স্বাভাবিকভাবে যারা বর্তমান সরকার পরিবর্তনের জন্য রাজপথে আন্দোলন-সংগ্রাম করছে, তাদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

বিএনপি নিয়ে নুরুল হককে প্রশ্ন

গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক বলেছিলেন বিএনপি ও আওয়ামী লীগের চরিত্র একই। গত ৩৪ বছর তাঁরা দুই দলের শাসন দেখেছেন, এদের দিয়ে হবে না। এ বক্তব্যের উল্লেখ করে সাংবাদিকেরা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামের কাছে এ বিষয়ে জানতে চান।

জবাবে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি অনুরোধ করব, এটা নুরু (নুরুল হক নুর) সাহেবই উত্তর দেবেন।’ এ পর্যায়ে সাংবাদিকেরা নুরুল হককে প্রশ্ন করেন, আপনার গতকালের বক্তব্য আর আজকের অবস্থান মেলে না।

নুরুল হক বলেন, ৩৪ বছর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। এটা ঠিক যে তাদের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় অনেক কিছুর মিল থাকে। এখন বাংলাদেশ যে জায়গাটায় দাঁড়িয়েছে, সেখানে নতুন বন্দোবস্ত, নতুন ব্যবস্থাপনা দরকার। সে ক্ষেত্রে বিএনপি তো তার পুরোনো অবস্থান থেকে সরে এসেছে। তারা নির্বাচন-পরবর্তী বর্তমান ব্যবস্থার পরিবর্তনে একটা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে।

নুরুল হক বলেন, ‘আমরা এখানে যে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলছি, সংবিধানের ৭০ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিবর্তনসহ বিশেষ ক্ষমতা আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ গণবিরোধী আইন বাতিল করা—সেখানে বিএনপি একমত পোষণ করেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার ভারসাম্যের কথা বলেছি, এখনেও বিএনপি একমত পোষণ করেছে। সুতরাং এই নতুন বন্দোবস্তিতে শুধু বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগও যদি একমত পোষণ করে, সেটাও আলোচনা হতে পারে।’

এ পর্যায়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি একটু কথা বলতে চাই। সেটা হচ্ছে বিএনপি কী করেছে না করেছে, সেটা দেশের মানুষ সবাই জানে। আপনারা জানেন যে একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাকশাল থেকে বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছিল বিএনপি। সংসদীয় গণতন্ত্র নিয়ে এসেছিল বিএনপি। এ দেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে বিএনপি। বিচারপতি নিয়োগের ব্যাপারে কমিশন করা, রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার ভারসাম্যের কথাও বিএনপির ভিশন ২০৩০তে আছে। অর্থাৎ তাদের চিন্তা এবং আমাদের চিন্তার মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই।’

সাংবাদিকদের সব সময় ইতিবাচক দিক সমর্থন করার অনুরোধ জানিয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘জাতির বর্তমান যে অবস্থা, সেখানে বিএনপি বা গণ অধিকার পরিষদ লড়াই করলে কিন্তু সফলতা আসবে না। আপনাদের অবস্থান থেকেই লড়াই করতে হবে আপনাদের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য।

ডিজিটাল সিকিউরটি অ্যাক্টসহ বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন আপনাদের ধ্বংস করে দিচ্ছে, আপনারা লিখতে পারছেন না প্রাণ-মন খুলে। অনেক গুণী সাংবাদিক দেশে ছেড়ে চলে গেছেন। এই লড়াই শুধু বিএনপি লড়াই নয়, এই লড়াই জাতির বেঁচে থাকার, অস্তিত্বের লড়াই।’

সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধি দলে স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক জহির উদ্দিন স্বপন উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে রেজা কিবরিয়া ও নুরুল হক ছাড়াও সংলাপে গণ অধিকার পরিষদের আটজন নেতা অংশ নেন।