আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহারকে মূল চ্যালেঞ্জ মনে করছে নির্বাচন কমিশন। সাংবিধানিক এই সংস্থা মনে করে, ইন্টারনেট বন্ধ করে কিংবা গতি কমিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা যাবে না। অন্যদিকে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা মনে করেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো না গেলে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে।
গতকাল সোমবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে পৃথক সংলাপ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। দুই ধাপে এই সংলাপ হয়। সকালে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার এবং বিকেলে প্রিন্ট মিডিয়ার জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকেরা সংলাপে অংশ নেন। নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকেরা তাঁদের বিভিন্ন পরামর্শ এবং প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনী হলফনামা, পর্যবেক্ষক সংস্থাসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে আসে।
আমরা একদম স্বচ্ছভাবে আয়নার মতো পরিষ্কার করে এই ইলেকশনটা করতে চাই।এ এম এম নাসির উদ্দীন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার
দুই ধাপের সংলাপের (সকালে ও বিকেলে) শুরুতে বক্তব্য দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন। তিনি বলেন, ‘আমরা একদম স্বচ্ছভাবে আয়নার মতো পরিষ্কার করে এই ইলেকশনটা করতে চাই। এ ক্ষেত্রে আপনাদের (সাংবাদিকদের) সহযোগিতাটা খুবই দরকার হবে।’
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ইসির কার্যক্রমকে সহজ করে, এমনটি উল্লেখ করে সিইসি বলেন, গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য সঠিক হলে কমিশন সেই তথ্যের আলোকে পদক্ষেপ নেয়। তিনি বলেন, নির্বাচন ভালো না হওয়া ছাড়া সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। দেশ ও জাতির জন্য সুষ্ঠু নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে সবকিছু সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। সবাই মিলে নির্বাচনটা করতে হবে।
আইনশৃঙ্খলা নিয়ে উদ্বেগ
ইসির সঙ্গে বিকেলের সংলাপে যুগান্তর সম্পাদক আবদুল হাই শিকদার বলেন, দেশে বর্তমানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক। এমন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। বিদ্যমান পুলিশ প্রশাসন দিয়ে কীভাবে নির্বাচন হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।
দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে একই দিনে সারা দেশে নির্বাচন পরিচালনা করা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ। তিনি একাধিক দিনে নির্বাচন পরিচালনা করার পরামর্শ দেন।
একাধিক দিনে সংসদ নির্বাচন করার পরামর্শ দেন দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদক আযম মীর শাহীদুল আহসানও।
নির্বাচনকালীন পেশিশক্তি এবং কালোটাকার প্রভাবের বিষয়ে নজর দেওয়া দরকার বলে উল্লেখ করেন প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি বলেন, আরপিওতে প্রার্থীর আয়করের বিষয়ে যাচাই–বাছাই করার কথা বলা থাকলেও পূর্বের কমিশনগুলো তা এড়িয়ে গেছে। সেই ফাঁক দিয়ে দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলো আইনপ্রণেতা হয়ে যাচ্ছেন। সেই সঙ্গে ডিজিটাল মাধ্যমে অর্থ ব্যয় করে জনমত যেন প্রভাবিত করা না হয়, সে বিষয়ে ইসিকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
কার্যক্রম নিষিদ্ধ দলের ভোটারদের নিয়ে কী চিন্তা
রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা হলেও তাদের সমর্থক ভোটারদের বিষয়ে ইসির ভাবনা সম্পর্কে সংলাপে প্রশ্ন ওঠে। কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ যেটা কার্যক্রম নিষিদ্ধ আছে, সেটার ব্যাপারে আপনাদের (ইসির) বক্তব্য আমরা জানতে চাই। না হলে তো এটা গ্রহণযোগ্য হবে না।
আওয়ামী লীগের ভোটারদেরকে তো আপনি বাদ দিতে পারবেন না। তারা তো দেশের নাগরিক। তারা যদিও অনুশোচনা করে নাই, এখন পর্যন্ত প্রায়শ্চিত্ত করে নাই, অনুতপ্ত হয় নাই। কিন্তু তারপরেও তাদেরকে বাদ দিয়ে তো নির্বাচনটা হতে পারে না।’
তবে একটি দল নির্বাচনে অংশ না নিলে নির্বাচন অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে না—এমনটি মনে করেন না প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মারুফ কামাল খান। তিনি বলেন, একটি দল তাদের অতীত অপকর্মের জন্য নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এটা চ্যালেঞ্জ যে তাদের সমর্থকেরা ভোটকেন্দ্রে আসবেন কি না। তবে নির্বাচনকে যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং মানুষকে উৎসাহিত করা গেলে নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে।
খবরের কাগজ সম্পাদক মোস্তফা কামাল মনে করেন, উৎসবমুখর নির্বাচনের উৎসব অর্ধেক মানুষকে বাইরে রেখে হতে পারে না। তাদেরকে কীভাবে আনা যাবে, বিচারপ্রক্রিয়া কত দ্রুত করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে।
রোষানলে পড়তে হয় সাংবাদিকদের
আগামী নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোট গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা থাকলেও বিদেশে থাকা বাংলাদেশের মিশনগুলোর সক্ষমতা ও কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা কতটা আছে, তা নিয়ে সংলাপে প্রশ্ন তোলেন চ্যানেল আইয়ের প্রধান নির্বাহী সম্পাদক জাহিদ নেওয়াজ খান।
একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শফিক আহমেদ বলেন, নির্বাচনের আগে–পরে জয়ী ও হেরে যাওয়া সব পক্ষের রোষানলে পড়তে হয় সাংবাদিকদের। তাই সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইসির ভূমিকা থাকা উচিত।
যমুনা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক তৌহিদুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনের সময় সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখতে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবে, সেটা পরিষ্কার নয়। কারণ, নির্বাচনের পরে তারা আবার দলীয় সরকারের অধীনে পরিচালিত হবে।
ভালো নির্বাচনের জন্য
দুই ধাপের সংলাপ শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার এখন বৈশ্বিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে অপব্যবহারকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে শনাক্ত করা যায় না। অপব্যবহারকারীদের বেশির ভাগ দেশের বাইরে থেকে কার্যক্রম চালায়। তবে বিষয়টি মোকাবিলায় তাঁরা ইউএনডিপির সহযোগিতা নিচ্ছেন। পাশাপাশি পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিটিআরসির সক্ষমতাকে সমন্বয় করে কাজ করছেন।
এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, বিগত নির্বাচনগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শক্তিশালী অবস্থানে থেকে খারাপ নির্বাচনের জন্য কাজ করেছিলেন। এবার তাঁরা অতটা শক্তিশালী অবস্থানে নেই। তবে কাজ করবেন ভালো নির্বাচনের জন্য।
ইসির সঙ্গে দুই ধাপের সংলাপে অংশ নেন আজকের পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক কামরুল হাসান, বাসসের প্রধান সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক এ এস এম জাহীদ, ইউএনবির সম্পাদক মাহফুজুর রহমান, দৈনিক আমার দেশ–এর নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ, ডিবিসি নিউজের সম্পাদক লোটন একরাম প্রমুখ।