ওসমান হাদিকে গুলি, জামাল উদ্দীনকে হেনস্তা
গণতান্ত্রিক রূপান্তর চায় না যারা, তারাই এর পেছনে: আনু মুহাম্মদ
ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক শরিফ ওসমান হাদিকে গুলি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ–সমর্থক শিক্ষক আ ক ম জামাল উদ্দীনকে হেনস্তা, দুই ঘটনারই নিন্দা জানিয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।
আজ শুক্রবার বিকেলে ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক সাংস্কৃতিক সমাবেশে আনু মুহাম্মদ বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফেরাতে যারা চায় না, এই ঘটনাগুলোর পেছনে তারাই রয়েছে।
বাউল আবুল সরকারের মুক্তি ও তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহারসহ ৯ দফা দাবিতে ‘আক্রান্ত ও ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণের প্রতিরোধ যাত্রা’ শিরোনামে বিভিন্ন বামপন্থী রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন যৌথভাবে এই সমাবেশের আয়োজন করে। আনু মুহাম্মদ এই সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন।
আজ দুপুরে ঢাকার বিজয়নগরে গুলি করা হয় ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদিকে, যিনি আওয়ামী লীগের কড়া সমালোচক হিসেবে পরিচিত। গতকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী লীগ–সমর্থক শিক্ষক জামাল উদ্দীনকে হেনস্তা করেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক যুবাইর বিন নেছারী (এ বি জুবায়ের)।
দুই ঘটনার প্রসঙ্গ ধরে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘জামাল উদ্দীন কিংবা ওসমান হাদি কী রাজনৈতিক চিন্তা ধারণ করেন, কী মতামত পোষণ করেন, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁদের অবস্থান কী, সেটা আমাদের দৃষ্টিতে অপ্রাসঙ্গিক। আমরা মনে করি, প্রত্যেকের নিজ নিজ মতপ্রকাশের অধিকার আছে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য সেই জায়গাটা সমাজে তৈরি করতে হবে। যারা গণতান্ত্রিক রূপান্তরে বাধা সৃষ্টি করতে চায়, তারাই এ ধরনের সন্ত্রাস করছে।’
পদে পদে হতাশা তৈরি হচ্ছে
দেশে যে অবস্থা চলছে, তা ২০২৪ সালে গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মন্তব্য করেন আনু মুহাম্মদ, যিনি গত বছরের ২ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের দাবিতে দ্রোহযাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘পদে পদে সে ক্ষেত্রে আমাদের প্রত্যাশা ভঙ্গ হচ্ছে, হতাশা তৈরি হচ্ছে এবং সমাজের মধ্যে ক্রমান্বয়ে বিভিন্ন বৈষম্যবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা দেখতে পাচ্ছি। সন্ত্রাসী হামলা, মব সন্ত্রাস দিন দিন বাড়ছে। সরকার ও প্রশাসনের কাছে দাবি জানাই, এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতাকে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার বদলে অগণতান্ত্রিক শক্তিকে দমন করার দায়িত্ব যেন তারা পালন করে।’
তফসিলের পর কোনো বিক্ষোভ সমাবেশ হলে দমন করা হবে—সরকারের এমন ঘোষণা সম্পর্কে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, জনগণের বিক্ষোভ তৈরি হয়, জনস্বার্থবিরোধী কিংবা সন্ত্রাসী তৎপরতা চলে, এ রকম কিছুর পৃষ্ঠপোষকতা যেন সরকার না করে।...গোপন-অস্বচ্ছ চুক্তির মাধ্যমে সরকার বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক চক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি বিপদের মধ্যে নিক্ষেপ করছে। এ ধরনের তৎপরতা থেকে সরকার যেন বিরত থাকে।’
‘ধর্মীয় ও করপোরেট ফ্যাসিবাদের সম্মিলন’
বৈষম্যবাদী গোষ্ঠী কখনো ধর্মের নাম করে, কখনো জুলাইয়ের নাম করে, কখনো জাতি কিংবা বিভিন্ন ধরনের পরিচয়ের ওপর ভর করে বৈষম্যবাদী রাজনীতি ও মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ করেন আনু মুহাম্মদ।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, কিছু গোষ্ঠী মানুষের সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি সহ্য করতে পারে না। তারা গান-নাচ বন্ধ করতে চায়, শিল্পকলার ওপর আক্রমণ করে, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা—সবকিছুই তারা বন্ধ করতে চায়।
অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ এবং করপোরেট ফ্যাসিবাদ—এই দুইয়ের সম্মিলন দেখা যাচ্ছে মন্তব্য করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘গণ-অভ্যুত্থানের যে প্রত্যাশা ছিল, সেটার প্রতিনিধিত্ব না করে তারা একদিকে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়, আরেক দিকে করপোরেট ফ্যাসিবাদ-সাম্রাজ্যবাদের জন্য বিভিন্ন ধরনের চুক্তি, আয়োজন ও ব্যবস্থা তৈরি করতে চেষ্টা করে। করপোরেট ফ্যাসিবাদ ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের আশ্রয়কেন্দ্র হয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গণ-অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমরা কোনোমতেই এটা অব্যাহত রাখতে দিতে পারি না। একাত্তর ও চব্বিশের শক্তি নিয়ে আমরা জনগণের সেই প্রত্যাশাকে আরও বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিরোধ যাত্রা অব্যাহত রাখতে চাই।’
স্বরাষ্ট্র ও সংস্কৃতি উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি
এই আয়োজনে প্রথম পর্বে গান, নাটক ও আবৃত্তির পাশাপাশি চলে বক্তব্য। আয়োজনের ঘোষণাপত্র পাঠ করেন বিবর্তন সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক আমিরুন নুজহাত মনীষা। এতে ৯ দফা দাবি জানানো হয়। সেখানে বাউল আবুল সরকারের মুক্তি ছাড়াও আছে সারা দেশে বাউল, অন্যান্য শিল্পীসহ মাজার-দরবার-সুফিদের ওপর হামলাকারীদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার, প্রতিটি হামলার বিচার ও আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা; প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গান ও শরীরচর্চার শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত পুনর্বহাল; জাতীয় স্বার্থ ও প্রাণপ্রকৃতিবিনাশী সব ধরনের প্রকল্প ও চুক্তি অবিলম্বে বাতিল এবং মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও সংস্কৃতি উপদেষ্টার পদত্যাগ।
আয়োজনের দ্বিতীয় পর্বে ছিল বাউলগানের আসর। পরে সন্ধ্যায় শহীদ মিনার থেকে একটি মশালমিছিল বের করা হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি, গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট, উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিল উইমেন্স ফেডারেশন, গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রসহ বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা এই কর্মসূচিতে অংশ নেন।