প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে সংস্কার ও নির্বাচনে গুরুত্ব
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে সংস্কার ও নির্বাচনকে প্রাধান্য দিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ও রাজনৈতিক অন্য দলগুলো। এ সময় বিএনপি দ্রুত নির্বাচনী রোডম্যাপ চেয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠন ও সংস্কার একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হবে, যাতে দ্রুত একটা নির্বাচন করা যায়।
নবগঠিত সংস্কার কমিশন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সামনে রেখে গতকাল শনিবার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।
রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রথম দিনে বেলা আড়াইটায় বিএনপিকে দিয়ে আলোচনা শুরু হয়। এরপর একে একে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ হয়। সব মিলিয়ে পাঁচটি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে প্রথম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীদের এই সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে এখন পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে আগামী শনিবার আরও কয়েকটি দলকে সংলাপে ডাকা হতে পারে বলে জানা গেছে।
গতকালের সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দিনের সংলাপ শেষে গতকাল রাতে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারকাজের পাশাপাশি নির্বাচনের কার্যক্রম এগিয়ে নেবেন বলে দলগুলোর নেতাদের জানিয়েছেন।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ছয়টি কমিশন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলবে। তিন মাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। এরপর ওই প্রতিবেদন নিয়ে আবার অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করবে। রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সময়।
সংলাপে আগামী জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারসহ মোটামুটি ১৮টি বিষয়ে কথা বলেছে বিএনপি। তবে দলটির মূল চাওয়া ছিল কবে নাগাদ নির্বাচন হবে, তার একটি রোডম্যাপ। একই সঙ্গে বিএনপি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে।
দলটির নেতারা রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে তাঁদের ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কার প্রস্তাব সামনে রেখে কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, ভোটে নির্বাচিত হলে তাঁরা এই সংস্কারগুলো করবেন। এটা বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দলগুলোর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।
বিএনপির প্রতিনিধিদল এক ঘণ্টার বেশি সময় বৈঠক করে। বিকেল চারটায় বৈঠক থেকে বের হয়ে প্রতিনিধিদলের প্রধান মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। আলোচনার সারবস্তু উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্বাচন–সম্পর্কিত। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটি রোডম্যাপ দিতে বলেছি।’
৯ মিনিটের ব্রিফিংয়ে মির্জা ফখরুল শুধু একটি প্রশ্নের জবাব দেন। নির্বাচনের ‘রোডম্যাপ ও সময়সীমা’ সম্পর্কিত প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মাস, দিন, কাল নিয়ে কথা বলব না। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাঁদের ১ নম্বর প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তাঁরা দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাঁদেরও দাবি।’
দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলোচনায় অংশ নেওয়া স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান ও সালাহউদ্দিন আহমেদকে নিয়ে এ ব্রিফ করেন।
বিএনপির ১৮ বিষয়
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারে কোনো বিতর্কিত ব্যক্তি যাতে না থাকেন, জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের আইন বাতিল করা, ফ্যাসিবাদের সময়ে হাইকোর্টে নিয়োগপ্রাপ্ত ৩০ বিচারকসহ ‘দলকানা’ বিচারকদের অপসারণ, জেলা প্রশাসক নিয়োগে নতুন ‘ফিটলিস্ট’ তৈরি এবং অভিযোগ ওঠা জেলা প্রশাসকদের নিয়োগ বাতিলসহ ১৮টি বিষয় তাঁরা তুলে ধরেছেন।
বিএনপির সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, বৈঠকে বিএনপি অন্তর্বর্তী সরকারের দুজন উপদেষ্টার কার্যক্রম নিয়ে আপত্তি জানিয়েছে। এ বিষয়ে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে দু-একজন আছেন, যাঁরা বিপ্লব, গণ-অভ্যুত্থানের যে মূল স্পিরিট, সেটি ব্যাহত করছেন। আমরা তাঁদের সরানোর কথা বলেছি।’ এ ছাড়া সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংসের মূল হোতা ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতি বাতিলের নায়ক অভিহিত করে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন বলেও উল্লেখ করেন মির্জা ফখরুল।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, এখনো বিগত সরকারের দোসর কিছু আমলা, পুলিশ কর্মকর্তা রয়ে গেছেন। বিগত সরকারের মন্ত্রীরা পালিয়ে গেছেন। কীভাবে পালিয়ে যাচ্ছেন, কার সহযোগিতায় পালাচ্ছেন, এই বিষয়গুলো দেখার জন্য তিনি বলেছেন। তিনি অভিযোগ করেন, গণহত্যার তথ্য অনুসন্ধানে বাংলাদেশে আসা জাতিসংঘের প্রতিনিধিদলকে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা সহযোগিতা করছেন না। বিষয়টি তাঁরা সংলাপে জানিয়েছেন।
দুটি রোডম্যাপ চেয়েছে জামায়াত
আলোচনায় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার চেয়ে নির্বাচনের পথে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জামায়াত। এ জন্য জামায়াত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছে। তারা মনে করে, একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার ঠিকমতো না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর জামায়াতের আমির শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে দলটির সঙ্গে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা আলোচনা হয়। জামায়াত ৯ অক্টোবর সংস্কারের ব্যাপারে দলীয় প্রস্তাব প্রকাশ করবে।
পরে শফিকুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সব সংস্কার অন্তর্বর্তী সরকার করুক, এটা আমরা চাই না। তাহলে নির্বাচিত সরকার কী করবে। আমরা তাঁদের তা বলেছি।’ বৈঠকে জামায়াতের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, আ ন ম শামসুল ইসলাম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম অংশ নেন।
রাজনৈতিক কাউন্সিলের প্রস্তাব গণতন্ত্র মঞ্চের
রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। ছয়টি দলের এই জোটের অন্যতম নেতা জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে আরও সম্পৃক্ত করার তাগিদ দিয়েছেন তাঁরা। এ জন্য একটি কাঠামো তৈরি করার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা বলেছেন।
সংলাপে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন মাহমুদুর রহমান মান্না, সাইফুল হক, হাসনাত কাইয়ুম, হাবিবুর রহমান প্রমুখ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংবিধান যতটুকু সংশোধন দরকার, ততটুকু সংশোধন করার উদ্যোগেই যথার্থ হবে বলে মনে করে। সংলাপে উপস্থিত ছিলেন সিপিবির সভাপতি মো. শাহ আলম, সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন, সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের প্রধান উপদেষ্টা খালেকুজ্জামান প্রমুখ।
হেফাজতের দাবি
হেফাজতে ইসলাম মূলত সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ের করা মামলা, পাঠ্যপুস্তক পরিমার্জনের জন্য গঠিত সমন্বয় কমিটি, জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের খতিব ও ইসলামিক ফাউন্ডেশনে মহাপরিচালক নিয়োগের বিষয়ে কথা বলেছে। এর মধ্যে তারা বিগত সরকারের সময় ২০১৩, ২০১৬ ও ২০২১ সালে করা ৩৩৩টি মামলা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছে।
সংগঠনের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমানের নেতৃত্বে আলোচনায় আরও অংশ নেন আবদুর রব ইউসুফী, মাওলানা মাহফুজুল হক, মহিউদ্দীন রাব্বানী, আহমদ আবদুল কাদের, মঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী, মামুনুল হক প্রমুখ।
ইসলামী আন্দোলন ও এবি পার্টির প্রস্তাব
ইসলামী আন্দোলন ছয় সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আরও নয়টি কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হলো আইনবিষয়ক সংস্কার কমিশন, নাগরিক সেবাবিষয়ক, পররাষ্ট্রবিষয়ক, শিক্ষাবিষয়ক, বাক্স্বাধীনতাবিষয়ক, স্বাস্থ্যবিষয়ক, শ্রমজীবীবিষয়ক, সংখ্যালঘু ও নৃগোষ্ঠীবিষয়ক এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক সংস্কার কমিশন। দলের আমির ও চরমোনাইয়ের পীর সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করিমের নেতৃত্বে প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ মোসাদ্দেক বিল্লাহ, আশরাফ আলী আকনসহ ছয়জন আলোচনায় অংশ নেন।
এবি পার্টির আহ্বায়ক সোলায়মান চৌধুরীর নেতৃত্বে দলটির পাঁচ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশ নেয়। পরে দলের সদস্য সচিব মজিবুর রহমান সাংবাদিকদের কাছে তাঁদের ১১ দফা প্রস্তাবনার কথা জানান।
দলটি বলেছে, সংলাপে তারা নানা প্রতিকূলতা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার মাধ্যমে সরকারের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি উল্লেখ করে বলেছে, যেসব মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সন্তোষজনক নয়, সেখানে দায়িত্ব রদবদল বা নতুন উপদেষ্টা নিয়োগের মাধ্যমে কার্যকর গতিশীলতা আনা দরকার।