ছাড় দিয়ে আপস–সমঝোতায় রাজি নয় আ.লীগ ও বিএনপি

  • সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ আছে কি না? অভিন্ন এই প্রশ্ন ছিল মার্কিন দলের।

  • বিএনপি বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই।

  • আ.লীগের বক্তব্য, বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়।

রাজধানীর একটি হোটেলে সোমবার দুপুরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্‌–নির্বাচনী প্রতিনিধিদলের বৈঠক
ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় সফররত মার্কিন প্রাক্-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সঙ্গে পৃথক বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি, প্রধান দুই দলই নির্বাচন প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থান তুলে ধরেছে। তাদের কেউই নিজের অবস্থান থেকে কোনো ছাড় দিয়ে আপস–সমঝোতায় যেতে রাজি নয়।

বিরোধী দল বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাঁদের এক দফা দাবির সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরেছেন। মার্কিন প্রতিনিধিদলকে আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, বিএনপি সমঝোতা-আপসের কোনো পথ খোলা রাখেনি। কারণ, বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তারা সমঝোতা করবে না।

সফরের তৃতীয় দিনে গতকাল সোমবার দিনভর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে একের পর এক বৈঠক করেছে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সাবেক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী কার্ল ইন্ডারফার্থের নেতৃত্বে দেশটির ১২ সদস্যের প্রতিনিধিদল।

রাজধানীর গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বৈঠক করেন মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা। সেই বৈঠক শেষ করেই তাঁরা সরাসরি চলে যান বনানীতে শেরাটন হোটেলে। সেখানে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্যরা দুপুর ১২টা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টা বৈঠক করেন আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে দলটির মোট সাত নেতা ওই বৈঠকে অংশ নেন। মার্কিন দলের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগের ছয় সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

দুই দলের নেতারাই জানিয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বৈঠকগুলোতে মার্কিন প্রাক্‌–নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা কোনো মতামত দেননি। তাঁরা নির্বাচনের পরিবেশ নিয়ে কিছু প্রশ্ন করে দলগুলোর বক্তব্য ও অবস্থান জানার চেষ্টা করেছেন। দুই দলের কাছেই মার্কিন দলের একটি অভিন্ন প্রশ্ন ছিল যে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ আছে কি না? এই অভিন্ন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বক্তব্য পরস্পরবিরোধী ছিল বলেই দল দুটির সূত্রে জানা গেছে।

প্রধান দুই দলই নির্বাচন প্রশ্নে পরস্পরবিরোধী অনড় অবস্থান তুলে ধরেছে। ছাড় দিতে রাজি নয় কেউই।

ক্ষমতাসীন দলের নেতারা বলেছেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা তাঁদের অঙ্গীকার। আর বিএনপি বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই এবং বর্তমান সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

তবে মার্কিন প্রতিনিধিদল সাংবাদিকদের কাছে কোনো বক্তব্য দেয়নি।

‘ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন ছিল বিএনপির কাছে’

মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠক নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, ঘুরেফিরে একটিই প্রশ্ন তাঁরা করছেন, সেটি হচ্ছে—সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক ও আন্তর্জাতিক মানের বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হবে কি না, এবং সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হলে কী প্রয়োজন? এর জবাবে তাঁরা বলেছেন, শেখ হাসিনা সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা ভোট চুরির একটি প্রকল্প নিয়েছে, যেটিকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। এখান থেকে মুক্ত হতে হলে এ সরকারের পদত্যাগের পর নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।

বিএনপির এই নেতা তাঁদের দলের পক্ষে ওই বৈঠক সম্পর্কে ব্রিফ করেন। তিনি এ–ও বলেন, উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্ব একটা কথা বলেই যাচ্ছে—গ্রহণযোগ্য, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচন। তাদের এই কথা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি একই।

সোমবার সকাল সাড়ে ১০টায় মার্কিন প্রাক্‌-নির্বাচনী পর্যবেক্ষক দলের সদস্যরা বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে এ বৈঠক করেন
ছবি: সাজিদ হোসেন

বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির অন্য একাধিক নেতা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের দাবি কেন করা হচ্ছে, এই প্রশ্নও ছিল মার্কিন প্রতিনিধিদলের।

এই প্রশ্নে বিএনপির নেতারা আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে তাঁদের এক দফা দাবির সমর্থনে যুক্তি তুলে ধরেছেন। তাঁরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন, একই সঙ্গে আন্দোলন দমনে বিএনপি নেতা–কর্মীদের গ্রেপ্তার–হয়রানি ও পুরোনো মামলায় বিচার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করাসহ দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিও তুলে ধরেছেন।

মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনায় বিএনপির পক্ষ থেকে দলটির নেতাদের মধ্যে আরও অংশ নিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মোহাম্মদ ইসমাইল জবিউল্লাহ, বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ ও বিএনপির মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ।

‘সংবিধানের বাইরে আপস–সমঝোতা নয়’

আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধিদলের বৈঠকে আলোচনায় বিএনপির নির্দলীয় সরকারের দাবির বিষয়টি এসেছে।

গতকাল দুপুরে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের কাছে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘তাঁরা (মার্কিন দল) বলেছে, ‘কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্ট (সমঝোতা ও আপসের) মাধ্যমে সমাধান খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না? আমরা বলেছি, কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের জন্য স্পেস থাকতে হয়। সেই স্পেস বিএনপি রাখেনি, ব্লক করে দিয়েছে।’

এ ব্যাপারে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘বৈঠকে আমি সূচনা বক্তব্যেই বলেছি, গণতন্ত্র এমন একটি বিষয়, যেখানে কম্প্রোমাইজ ও অ্যাডজাস্টমেন্টের সুযোগ থেকেই যায়; কিন্তু বিএনপি আগামী নির্বাচন নিয়ে সমঝোতার কোনো পথ খোলা রাখেনি। কারণ, বিএনপির দাবি সংবিধানসম্মত নয়। সংবিধান লঙ্ঘন করে তো আমরা সমঝোতা করব না।’

এ ধরনের বক্তব্যের ব্যাপারে ব্যাখ্যায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘প্রথমত বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো মৃত একটি ইস্যুকে সামনে এনেছে। তাদের এক দফা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তি, নির্বাচন কমিশন বাতিল করতে হবে। এসব দাবির মুখে কীভাবে সমঝোতা হবে।’

বৈঠকে অংশ নেওয়া আওয়ামী লীগের অন্য একাধিক নেতা জানিয়েছেন, অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কীভাবে নিশ্চিত করবে সরকার—এই প্রশ্নও ছিল মার্কিন প্রতিনিধিদের। এর জবাব আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল, তাঁরাও অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ। তবে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার অবস্থানেই অনড় থাকার কথা জানিয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে আরও উপস্থিত ছিলেন দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ফারুক খান, আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া, তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক সেলিম মাহমুদ ও কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত।

এদিকে গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরিবেশসহ নির্বাচন-পূর্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বাংলাদেশ সফর করেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রাক্-নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল। তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ণাঙ্গ পর্যবেক্ষক দল না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)।