পরিবহন ধর্মঘট, পুলিশি তৎপরতা, ক্ষমতাসীন দলের মহড়াসহ নানা উত্তেজনার মধ্যেও শেষ পর্যন্ত সিলেটে গত শনিবার শান্তিপূর্ণভাবে গণসমাবেশ করেছে বিএনপি। দলটির নেতাদের দাবি, দলীয় প্রধানের অনুপস্থিতিতে সিলেটে এর আগে এত বড় জমায়েত হয়নি। গণসমাবেশ ঘিরে সিলেট জেলা ও মহানগর বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও বিভক্তি আপাতত থামানো গেছে। একই সঙ্গে এই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে সাংগঠনিক গতি এবং নেতা-কর্মীদের মধ্যে সম্প্রীতি বেড়েছে। তাঁরা এখন এই উদ্দীপনাকে কাজে লাগিয়ে দল গোছানোকে অগ্রাধিকার দিচ্ছেন।
এই বিষয়ে সিলেটের মেয়র ও বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা আমাদের কৃতিত্ব না। এই সমাবেশের দাবির প্রতি সাধারণ মানুষের সমর্থন ছিল।’ তাঁর দাবি, বড় দলের প্রধান নেতা বা সরকারপ্রধান ছাড়া এ ধরনের বড় সমাবেশ সিলেটে প্রথম।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা প্রকাশ্য আলোচনায় বিএনপির এই সমাবেশকে বড় জমায়েত বলতে রাজি নন। তবে ব্যক্তিগত আলোচনায় স্বীকার করছেন যে বিএনপির কর্মসূচি ঘিরে পরিবহন ধর্মঘটসহ অন্যান্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি না করলেই ভালো হতো। কারণ, যারা আসার তারা ঠিকই সমাবেশে এসেছে। যানবাহন চলাচল বন্ধ করে উল্টো বিএনপির জেদ তৈরি করা হয়েছে এবং তাদের কর্মসূচিটি সারা দেশে আলোচনায় এসেছে।
যদিও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি যেভাবে আওয়াজ দিয়েছে, সেভাবে মানুষ আসেনি। মাঠ ফাঁকা ছিল। মানুষ বিএনপিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। সমাবেশ ঘিরে বাধাবিপত্তি সৃষ্টির অভিযোগও সত্য নয় বলে দাবি করছেন ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গণসমাবেশের পর এখন সিলেট বিএনপির দৃষ্টি দলের মহানগর ও জেলার সংগঠন গোছানোর দিকে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নজর সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনের দিকে।
বিএনপির এই কর্মসূচি ঘিরে জেলা ও মহানগরের নেতাদের মধ্যে কোন্দল থামাতে পারায় দলের শীর্ষ নেতৃত্ব খুশি বলে দলীয় সূত্র জানিয়েছে। তবে নেতাদের এই কোন্দল ও বিভক্তি কতটা থেমেছে, তা সামনের কর্মসূচিগুলোতে আরও স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন দায়িত্বশীল একাধিক নেতা।
দলীয় সূত্র থেকে জানা গেছে, একসময় সিলেট বিএনপিতে সাইফুর রহমান ও এম ইলিয়াস আলীর দুটি ধারা তৈরি হয়েছিল। এখন সেটি নানাজন ঘুরে খন্দকার আবদুল মুক্তাদির ও মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে দুটি ধারায় ভর করেছে। যার প্রভাব পড়েছে সিলেট বিএনপির জেলা ও মহানগরসহ সব কমিটিতে। আবদুল মুক্তাদির বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, আর আরিফুল হক চৌধুরী কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য। জেলা ও মহানগর কমিটি এবং অঙ্গসংগঠনগুলোতে মুক্তাদিরের অনুসারীদের একচেটিয়া প্রাধান্য বলে আলোচনা আছে।
বিএনপির অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো বলছে, দীর্ঘদিন ধরে মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক আবদুল কাইয়ুম জালালী ও সদস্যসচিব মিফতাহ্ সিদ্দিকীর নেতৃত্বে দুটি পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। এর প্রকাশ্য রূপ পায় গত ২ আগস্ট মহানগর বিএনপির এক কর্মসূচিতে দুই পক্ষের পৃথক কর্মসূচি পালন করার মধ্য দিয়ে।
আবদুল কাইয়ুম স্থানীয় রাজনীতিতে আবদুল মুক্তাদিরের পক্ষে, আর মিফতাহ্ সিদ্দিকী মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। তবে গত ২৯ মার্চ কাউন্সিলরদের ভোটে আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিক কর্মসূচিতে মুক্তাদির ও আরিফুলকে একত্রে বসতে দেখা গেছে। সর্বশেষ গত শনিবার অনুষ্ঠিত বিভাগীয় গণসমাবেশ সামনে রেখে সব পক্ষই একত্রে কাজ করে।
আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, সিলেট বিএনপিতে কোনো উপধারা বা কোন্দল নেই, তার প্রমাণ শনিবারের গণসমাবেশ। তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয় এই মুহূর্তে কারও মধ্যে এই চিন্তাটুকুও নেই যে দলে আমার অবস্থানটা কী, আমি কোথায় বসব না বসব, আমাকে কে ডাক দিল বা দিল না। প্রত্যেকটা নেতা-কর্মীর মধ্যে একটা ফিলিংস চলে এসেছে যে দলের সিদ্ধান্ত সর্বশক্তি দিয়ে বাস্তবায়ন করতে হবে।’
সিটি নির্বাচন ঘিরে তৎপরতা
২০২৩ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হতে পারে। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বদরউদ্দিন আহমদ কামরানকে হারিয়ে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরী মেয়র নির্বাচিত হন। এবারের নির্বাচনে দলীয়ভাবে আরিফুল হকের প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, এই সরকারের অধীন আর কোনো নির্বাচনে বিএনপির অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগমুহূর্তে সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচন সংসদ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হয়ে আসবে। তাই সিলেট আওয়ামী লীগের দৃষ্টি গত নির্বাচনে হাতছাড়া হওয়া মেয়র পদটি পুনরুদ্ধারের দিকে। যে কারণে মেয়র ও কাউন্সিলর পদে আগ্রহী জেলা, মহানগর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা এখন থেকেই নির্বাচনী প্রচারে নেমে গেছেন।
দলীয় সূত্র জানায়, বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের মৃত্যুর পর মেয়র পদে সে পর্যায়ের প্রার্থী নেই আওয়ামী লীগে। তবে মেয়র পদে প্রার্থী হতে ইতিমধ্যে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের সাতজন নেতা তৎপরতা শুরু করেছেন।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে বিএনপি না এলে আরিফুল হক চৌধুরীর প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা কম। তাতে আওয়ামী লীগের মেয়র পদপ্রার্থী সহজে জয় পাবেন। এ কারণে মেয়র প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে আওয়ামী লীগে পুরোনো কোন্দল আবার বড় হয়ে উঠতে পারে। এরই মধ্যে নেতাদের মধ্যে মনোমালিন্য শুরু হয়েছে। আড়ালে একে অন্যের দোষত্রুটি সামনে আনার চেষ্টা করছেন।
ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি আসাদ উদ্দিন আহমদ, সাধারণ সম্পাদক মো. জাকির হোসেন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এ টি এম এ হাসান জেবুল ও আজাদুর রহমান, সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রয়াত মেয়র বদরউদ্দিন আহমদ কামরানের ছেলে আরমান আহমদ এবং সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান চৌধুরী নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছেন। তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় দলীয় সভা-সমাবেশে নিজেদের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
এদিকে বিএনপি সিটি নির্বাচনে অংশ না নিলে তখন সিলেট বিএনপি কী করবে, এমন প্রশ্ন সামনে আসছে। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেছেন, যেহেতু তিনি একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, তাই নির্বাচনের বিষয়ে তাঁর প্রবল আগ্রহ আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্ত হচ্ছে বর্তমান সরকারের অধীন বিএনপি আর কোনো নির্বাচনে যাবে না, এটাই তাঁর সিদ্ধান্ত।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, সম্প্রতি দলের সম্মেলনের মাধ্যমে সিলেট জেলা বিএনপির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ কমিটির শীর্ষ তিন পদে নেতা নির্বাচিত করা হয়েছে। শিগগিরই জেলার পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হবে। এ ছাড়া ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই কাউন্সিলের মাধ্যমে মহানগর কমিটি গঠিত হবে। ফলে আগামী কিছুদিন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়েই ব্যস্ত থাকবে বিএনপি।