ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর কয়েক মাস ধরে যে আলোচনা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে, তা একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর আগে এতগুলো রাজনৈতিক দলের একত্রে বসে মতবিনিময় বা যুক্তিতর্ক উত্থাপন করার নজির নেই। এবার দলগুলো ধৈর্য ধরে একটা ইতিবাচক পরিবেশে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখিয়ে যে আলোচনা করেছে, তা বিরল।
প্রথম দিকে আলোচনায় কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হৃদ্যতাপূর্ণ পরিবেশে সফল আলোচনাই হয়েছে। এটা অনেকটা ‘মিনি পার্লামেন্টের’ মতো কাজ করেছে, যা একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতে, এটি দেশের গণতান্ত্রিক উন্নয়নের পথও প্রশস্ত করবে।
আমাদের লক্ষ্য ছিল কতগুলো মৌলিক সংস্কারের দিকে নজর দেওয়া। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কতগুলো সাংবিধানিক ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপ্রক্রিয়া। এত দিন দলীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নির্বাহী বিভাগ এসব নিয়োগ দিয়ে এসেছে। যার ফলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। যেটি আমাদের ভোটাধিকার হরণ করেছে এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এবার আমাদের লক্ষ্য ছিল নির্বাচন কমিশন, সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, ন্যায়পাল ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ যাতে নিরপেক্ষ হয় এবং দুর্নীতি দমন কমিশনকে যাতে একটা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা যায়। এর মাধ্যমে নিরপেক্ষ, নির্দলীয় ব্যক্তিরা যাতে নিয়োগ পান, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়ায়।
আরেকটি বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার লাগাম টানা। প্রয়াত অর্থনীতিবিদ ড. আকবর আলি খানের মতে, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোগল সম্রাটদের চেয়েও বেশি ক্ষমতাবান।’ এমনকি রাশিয়ান জারদের থেকেও আমাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা অনেক বেশি। তাই প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা হ্রাস করাটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা একমত হতে পেরেছি যে এক ব্যক্তি একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধান হতে পারবেন না। একই সঙ্গে আমরা প্রধানমন্ত্রীর সর্বোচ্চ দুই মেয়াদ নির্ধারণে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। এগুলো একেবারে মৌলিক সংস্কার।
আরেকটা মৌলিক সংস্কার হচ্ছে সংবিধান সংশোধন। কথায় কথায় যাতে সংবিধান কাটাছেঁড়া করতে না পারে, সেই ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছি। আমরা সবাই জানি যে পঞ্চদশ সংশোধনী শেখ হাসিনাকে দানবে পরিণত হতে সহায়তা করেছে। মানুষের ভোটাধিকার হরণ হয়েছে। সংসদের উচ্চকক্ষ স্থাপনের মাধ্যমে নিম্নকক্ষে একতরফাভাবে জনমত উপেক্ষা করে, অন্যান্য দলের মতের প্রতি কোনো রূপ শ্রদ্ধা প্রদর্শন না করে আর সংবিধান সংশোধন করা যাবে না। সংসদের উচ্চকক্ষ পিআর (সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতিতে হবে। যার মাধ্যমে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে রায় দিয়েছেন। পঞ্চদশ সংশোধনীকে অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছেন। কিন্তু কীভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়োগ হবে, এটাও একটা মৌলিক সংস্কারের বিষয়। যাতে যোগ্য ব্যক্তিরা ওই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে আবারও আগের মতো ভোটের অধিকার ধ্বংস করতে না পারে। সে ব্যাপারে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছেছি।
জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া, বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ, উপজেলা পর্যায়ে স্থানীয় নিম্ন আদালতের সম্প্রসারণ, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, অর্থ বিল আর অনাস্থা প্রস্তাবে গোপন ভোট দেওয়াসহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক সংস্কার হয়েছে।
তবে কিছু ক্ষেত্রে কিছুটা অপূর্ণতা রয়ে গেছে। যেমন নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ব্যাপারে যতটুকু অর্জন করতে চেয়েছিলাম, ততটুকু পারিনি। তবু আমরা মনে করি, একটা গুরুত্বপূর্ণ যাত্রা শুরু হলো।
প্রবাদ আছে, ‘পুডিং কতটা সুস্বাদু বা ভালো হয়েছে, তা জানতে হলে খেয়ে দেখতে হবে।’ সংস্কারের সার্থকতা নির্ভর করবে বাস্তবায়নের ওপর। আমার বিশ্বাস, রাজনৈতিক দলগুলো প্রজ্ঞা এবং সাহসিকতার পরিচয় দেবে। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের রক্তের সঙ্গে আমরা যেন বিশ্বাসঘাতকতা না করি।
বদিউল আলম মজুমদার, সদস্য, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন
(মতামত লেখকের নিজস্ব)