বানি আমিনের ‘কৃতিত্বে’ হেলমেট বাহিনীর ‘অর্জনও’ ঝুঁকিতে

প্রকৌশলী ম ইনামুল হককে (বাঁয়ে) শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন কৃষক লীগ নেতা বানি আমিন
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ক্ষমতার ছায়াতলে থাকতে পারলে কী কী করা যেতে পারে সে তালিকায় আরও একটি বিষয় যুক্ত করার ‘কৃতিত্ব’ পেতেই পারেন তৃণমূলের কৃষক লীগ নেতা বানি আমিন। ‘ঝটিকা’ সিদ্ধান্ত নিয়ে যেভাবে হাত চালালেন তিনি, সেটি তাঁকে ইতিমধ্যে ভার্চ্যুয়াল জগতে ‘ভাইরাল’ করে তুলেছে। তিনি যে সংগঠনের ‘ছোট’ নেতা সেই সংগঠনের বড়-বড় নেতাদের নামও যেখানে বেশির ভাগ মানুষ জানে না সেখানে তিনি এখন দেশের ‘সুপরিচিত’ মুখ।

বানি আমিন প্রমাণ করলেন প্রতিপক্ষকে ‘উচিত শিক্ষা’ দিতে শুধু হেলমেট পরে মহড়া দেওয়া বা পিটিয়ে রক্তাক্ত করাই একমাত্র কৌশল হতে পারে না। থুতনির নিচে সামান্য মাস্ক পরেও বিরোধীদের ‘এক হাত’ নেওয়া যায়। শুধু প্রতিপক্ষের কর্মসূচির দিনেই সতর্ক থাকলে যে চলবে না সেটিও হাতে-কলমে দেখিয়ে দিয়েছেন তিনি। পথে-ঘাটে চোখ, কান খোলা রাখতে হবে তা না হলে কোন ফাঁকে কে, কী বিলি (প্রচারপত্র) করে বসবে, কে জানে!

হেলমেট বাহিনীকেও চরম পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন বানি আমিন। সুদূর মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজীপুর ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রাম ছেড়ে একদিনের জন্য  ঢাকায় এসেও নিজের ‘কর্তব্য’ ভুলে যাননি তিনি।
ধারালো অস্ত্র হাতে হেলমেট বাহিনী। গত এপ্রিলে ঢাকা কলেজের ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী ও দোকান কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়
ফাইল ছবি

ক্ষমতার দাপট দেখানোর বড় নমুনা ‘হেলমেট বাহিনী’। দেশের মানুষ তাদের প্রথম চিনতে পারে ২০১৮ সালে। কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হামলা করে আলোচনায় আসা ‘হেলমেট বাহিনী’ এরপরও অবশ্য বেশ কয়েকবার রাজপথে নিজেদের ‘শক্তি ও জাত’ চিনিয়েছে। ‘প্রয়োজন’ হলেই তাদের ডাক পড়ে এবং তারা বেশ সাফল্যও এনে দিতে পারে। তবে বিভিন্ন সময় হামলা-সংঘাতে ‘হেলমেট বাহিনী’ আলোচনায় এলেও তাঁদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার নজির খুব কম। হেলমেট পরে লাঠি, ধারালো অস্ত্র হাতে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে বিভিন্ন ঘটনায় চিহ্নিত করা হলেও পুলিশ-প্রশাসন এসব বিষয়ে কেন জানি ‘নীরব’ থাকে।

তবে এই হেলমেট বাহিনীকেও চরম পরীক্ষার মুখে ফেলে দিয়েছেন বানি আমিন। সুদূর মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজীপুর ইউনিয়নের বেতবাড়িয়া গ্রাম ছেড়ে একদিনের জন্য  ঢাকায় এসেও নিজের ‘কর্তব্য’ ভুলে যাননি তিনি। গত শনিবার রাজধানীর শাহবাগে চোখের সামনে এমন একটি ‘অন্যায্য’ ঘটনা দেখে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেননি বানি আমিন। সপাটে ‘হাত’ চালিয়েছেন। তাঁর ক্ষমতার দম্ভ ও আক্রোশের শিকার হয়েছেন দেশের প্রবীণ প্রকৌশলী ও সর্বজন বিপ্লবী দলের আহ্বায়ক ম ইনামুল হক। তাঁকে প্রকাশ্যে সবার সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেছেন বানি আমিন। আর ঘটনাটি ঘটেছে শাহবাগ থানার ১০০ গজের মধ্যে। তবে বিস্ময়ের কথা হচ্ছে সেখানে অসংখ্য মানুষ উপস্থিত থাকলেও কেউ প্রতিবাদ করেনি, এগিয়েও যায়নি। ইনামুল হকের ‘অপরাধ’ তিনি নিজ দলের পক্ষে সরকারবিরোধী প্রচারপত্র বিলি করেছেন।

ঢাকায় গত শনিবার প্রবীণ প্রকৌশলী ম ইনামুল হককে লাঞ্ছিত করেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কাজিপুর ইউনিয়ন কৃষক লীগের সভাপতি বানি আমিন
ছবি: প্রথম আলো
আরও পড়ুন

শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার ঘটনাটি ফেসবুকে ‘ভাইরাল’ (ছড়িয়ে পড়া) হয়েছে, দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ নিয়ে ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন সংগঠন এ বিষয়ে কঠোর বিবৃতি দিয়ে মোটামুটি দায়িত্ব শেষ করেছে। আর পুলিশ এ বিষয়ে ‘নীরব’ থেকেছে।

ম ইনামুল হক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক। এ ছাড়া হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং পানিসম্পদ পরিকল্পনা সংস্থায় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।  ইনামুল হক চরমভাবে হেনস্তা হওয়ার পরও বলেছেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ বা মামলা করতে চান না তিনি। তাঁর মতে, ‘এসব করে কী হবে!’ তাঁর এই বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর আপাতত ‘হাফ ছেড়ে’ বেচেছে পুলিশ।

আরও পড়ুন
আইনের একটি গতি আছে। এটি না দুর্বার না মন্থর। আইন সব সময়ই নিজস্ব গতিতে চলে।
নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে হেলমেট বাহিনীর হামলা।২০১৮ সালের ৫ আগস্ট রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়ে
ফাইল ছবি

বিশিষ্ট নাগরিকদের কেউ কেউ অবশ্য এই ঘটনার বিচার চেয়েছেন। তবে তাঁরা যত কথাই বলুক, আইনের একটি গতি আছে। এটি না দুর্বার না মন্থর। সেটি সব সময়ই ‘নিজস্ব গতি’। আশা করা যায় আইন এ ক্ষেত্রেও ‘নিজস্ব’ গতিতেই চলবে।

কেউ ‘ভুল’ করলে ক্ষমতাবানরা (পড়ুন কিছু জনপ্রতিনিধি) চাইলে কাউকে প্রকাশ্যে কান ধরে ওঠবস করাতে পারেন। কখনো তাঁরা ‘বেয়াড়া’ ব্যক্তিদের প্রতিও দয়াপরবশ হন। কেউ অবাধ্য হলেও থানা-পুলিশকে না জড়িয়ে নিজেরাই চড়-থাপ্পড় মেরে ঘটনাটি ‘মীমাংসা’ করে দেন। কিন্তু সেই মার খাওয়াতেও একটা ‘মর্যাদা’ থাকে। অন্তত সংসদ সদস্য বা উপজেলা চেয়ারম্যান বা মেয়র পদ মর্যাদার অধিকারী হন তাঁরা। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতারাও যদিও এখন ‘শিক্ষা’ দেওয়ার দায়িত্ব নিয়ে নেন তাহলে ‘আত্মসম্মান’ বোধ হয় আর থাকে না!

ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো