জাতীয় পার্টির ভবিষ্যৎ কী

জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদ; এই দুজন এখন জাতীয় পার্টির দুই পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেনফাইল ছবি

প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো যখন প্রার্থী ঘোষণা করে মাঠে নেমে গেছে, জাতীয় পার্টি (জাপা) তখনো নিশ্চিত নয় যে তারা আদৌ আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে কি না। এ প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকার শেষ পর্যন্ত কী অবস্থান নেয়, সেটিও দলটির কাছে স্পষ্ট নয়। এর সঙ্গে রয়েছে জি এম কাদের ও আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে বিভক্ত জাতীয় পার্টির দুই অংশের পরস্পরবিরোধী তৎপরতা। এসব কারণে দলটির ভবিষ্যৎ কী—সে আলোচনাও সামনে এসেছে।

গত ১৪ মাসে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক অবস্থান অনেকটাই কোণঠাসা। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলের সভা-সমাবেশে পুলিশের বাধা, কার্যালয়ে হামলা এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকার মতো ঘটনাগুলো এতে বড় ভূমিকা রেখেছে। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ইতিমধ্যে দলীয় মনোনয়ন প্রায় চূড়ান্ত করে নির্বাচনী প্রচারে নেমে গেছে।

তিন নির্বাচনের ‘দোসর’–বিতর্ক

বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বা ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’ হিসেবে সমালোচিত। এ দায় তারা এড়াতে পারছে না। ফলে ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’, এই তকমা দলটির রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এ সুযোগে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), ইসলামী আন্দোলন ও গণ-অধিকার পরিষদ প্রকাশ্যেই চাচ্ছে, জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়।

গত বছর গণ–অভ্যুত্থানের পর একাধিকবার রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা হয়েছে। গত ৩০ অক্টোবর রাতে সেখানে হামলা চালিয়ে আগুন দেয় কিছু ব্যক্তি
ফাইল ছবি: প্রথম আলো

যদিও তিনটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ায় জাতীয় পাটিকে ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’ বলার বিষয়ে দলটির নেতাদের ভিন্ন ব্যাখ্যা আছে। তাঁদের দাবি, ভোটে গিয়ে জাতীয় পার্টি কোনো অন্যায় করেনি। তাঁরা সংসদের ভেতরে–বাইরে আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যায়-অপরাধের যথাযথ সমালোচনা করেছেন। এর মধ্যে জি এম কাদের ‘দোসর’ পরিচয়ের দায় নিতে শুরু থেকেই অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছেন।

এ ছাড়া আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির নির্বাহী চেয়ারম্যান মো. মুজিবুল হক (চুন্নু) প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০২৪ সালের নির্বাচনে নৈতিকভাবে না যাওয়া উচিত ছিল। তবে নির্বাচনে গিয়ে আমরা আইনগতভাবে কোনো অন্যায় করিনি। এ জন্য আমাদের স্বৈরাচারের দোসর বলা হচ্ছে। আমরা যদি দোসর হই, এর বিচারটা জনগণের হাতে দেওয়াই তো ভালো।’

নির্বাচন করতে প্রস্তুত দুই পক্ষই

বিভক্ত জাতীয় পার্টির দুই অংশের উচ্চপর্যায়ের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, সেটি হলো তাঁরা এখন পর্যন্ত মনে করতে পারছেন না যে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে পারবে।

তবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর পরিস্থিতি অনুকূল বা প্রতিকূল যা-ই হোক, দলটির উভয় অংশই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। এ ক্ষেত্রে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশটি এককভাবে আর আনিসুল ইসলামের অংশটি জোটগত ভোটে বেশি আগ্রহী।

এ বিষয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা কিছু সমমনা দলের সঙ্গে কথা বলছি। এটা এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর মতো কিছু হয়নি। দেখা যাক, কী হয়।’

তবে এখন পর্যন্ত জাতীয় পার্টির জন্য যে পরিবেশ-পরিস্থিতি, তাতে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ কতটা পাবে, তা নিয়ে নেতাদের মধ্যে বেশ সংশয় আছে।

এ বিষয়ে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিস্থিতি যা-ই হোক, আমাদের হয় নির্বাচন করতে হবে, না হয় ঠেকানোর চেষ্টা করতে হবে। আমরা এককভাবে নির্বাচন করার চেষ্টা করব। কারও সঙ্গে মৌখিক সমঝোতাও করতে পারি।’

জানা গেছে, পরিস্থিতি নজরে রেখে জাতীয় পার্টির দুই পক্ষই ভোটে থাকার জুতসই উপায় খুঁজছে। নেতাদের ধারণা, জোটের মাধ্যমে ভোটে গেলে তাঁদের আসন-সম্ভাবনা বেড়ে যেতে পারে। তবে এসব সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক পরিবেশ কতটা স্থিতিশীল হয়, তার ওপর।

প্রতীক নিয়ে সংকট

জাতীয় পার্টি লোগো

এই মুহূর্তে জাতীয় পার্টির প্রধান সংকট হচ্ছে নেতৃত্ব ও প্রতীক নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ এবং আনিসুল ইসলাম মাহমুদের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক কাউন্সিলে গঠিত অপর অংশ—উভয়েই নিজেদের ‘মূল জাতীয় পার্টি’ দাবি করছে। দুই পক্ষের দূরত্ব এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দলীয় প্রতীক লাঙ্গল নিয়েই নির্বাচন কমিশনে পাল্টাপাল্টি আবেদন পড়েছে। প্রতীক বরাদ্দ ইস্যুতে এবার আদালতেরও দ্বারস্থ হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন আনিসুল ইসলাম মাহমুদরা। সব মিলিয়ে নির্বাচনের ঠিক আগে জাতীয় পার্টির অভ্যন্তরীণ বিভাজন ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দলটির জন্য গভীর এক সংকটের তৈরি করেছে।

এইচ এম এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্বে আসেন তাঁর ছোট ভাই জি এম কাদের
ফাইল ছবি

অবশ্য জি এম কাদের দলের এই বিভক্তিকে কোনো সমস্যা মনে করছেন না। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জাতীয় পার্টি আমার নামে নিবন্ধিত। নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটেও সেটি আছে। এখন জাতীয় পার্টির নামে কেউ আবেদন করলেই প্রতীক পেয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।’

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, দলের নেতৃত্ব নিয়ে, প্রতীক নিয়ে নানা রকম সংকট জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক দুর্বলতাকে প্রকট করে তুলেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংগঠন দুর্বল, মাঠে তৎপরতা নেই, নেতৃত্বের বিভক্তি দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ জটিল করে তুলেছে।

সরকারের উপেক্ষা

অন্তর্বর্তী সরকার শুরু থেকেই জাতীয় পার্টিকে উপেক্ষা করে চলেছে। সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের যে কয়েক দফা সংলাপ হয়েছে, তাতে দলটিকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। নির্বাচন কমিশনও নিবন্ধিত দল হিসেবেও তাদের ডাকেনি। দুই দশক আগে ক্ষমতার শরিক থাকলেও এখন জাতীয় পার্টি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ফোরামগুলো থেকে প্রায় বাদ পড়া একটি দল—এমন বাস্তবতা নেতাদের কাছেও অস্বস্তিকর। অন্যদিকে এই উপেক্ষা দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব স্পষ্ট একটি সংকেত দেয় যে বর্তমানে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক—দুই অঙ্গনেই দলটি প্রান্তিক। এমন পরিস্থিতিতে পড়ে জি এম কাদের সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে তির্যক বক্তব্য দিচ্ছেন। সংবাদপত্রে কলামও লিখছেন।

তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এসব বক্তব্য স্পষ্টত হতাশা ও আনুষ্ঠানিক রাজনীতিতে জায়গা কমে যাওয়ার প্রতিক্রিয়া। একই সঙ্গে বক্তব্যগুলো কার্যত সরকারি ও নির্বাচনসংশ্লিষ্ট মহলের দৃষ্টি আকর্ষণেরও চেষ্টা, যাতে শেষ মুহূর্তে হলেও নির্বাচনমুখী দলে স্থান পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন

ভয় কোথায়

ইতিমধ্যে সরকারপ্রধান জানিয়েছেন, কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবে না। আওয়ামী লীগের মিত্র জোট ১৪ দলের শরিক দলগুলোও কোণঠাসা হয়ে আছে। তাদেরও রাজনৈতিক কার্যক্রম নেই। অন্যদিকে জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল প্রকাশ্যেই দাবি তুলেছে, ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’ জাতীয় পার্টি যেন নির্বাচন করার সুযোগ না পায়।

জাতীয় পার্টির একাংশের মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার
ফাইল ছবি

‘ফ্যাসিবাদের দোসর’—এটাকে রাজনৈতিক গালি বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির (একাংশ) মহাসচিব এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনি আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনের বাইরে রাখার পরিণতি সম্পর্কে প্রথম আলোকে বলেন, এভাবে যদি আবারও একটি একতরফা নির্বাচন হয় এবং তাতে যারা ক্ষমতায় আসবে, ভবিষ্যতে তাদেরও যদি পতন হয়, তখন যারা এ নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল, তাদেরও তো দোসর বলা হবে। সুতরাং এটা পলিটিক্যাল গালি হিসেবেই থাকবে।

রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন, জামায়াতসহ যেসব দল নির্বাচনে জাতীয় পার্টির অংশগ্রহণের বিরোধী, তাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য রয়েছে। সেটি হচ্ছে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির অবর্তমানে রাজনীতিতে যে শূন্যস্থান তৈরি হয়েছে, সেটি নিজেদের দখলে নেওয়া এবং নির্বাচনে বিরোধী দলের আসনে বসা। আওয়ামী লীগের অবর্তমানে জাতীয় পার্টি যদি নির্বিঘ্নে নির্বাচন করার সুযোগ পায়, তাহলে আওয়ামী লীগের ভোটের বড় অংশ তাদের পক্ষে যেতে পারে।

এ বিষয়ে জি এম কাদের প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা বিভিন্নভাবে এ সরকারের সময় নির্যাতিত, তারা আমাদের সমর্থন দেবে। আওয়ামী লীগ এবং সংখ্যালঘুদেরও সমর্থন পাব বলে আমরা বিশ্বাস করি।’

তবে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ইচ্ছা, প্রার্থী ঠিক করার চেষ্টা চললেও এবার বৈরী পরিস্থিতির কারণে দলের পুরোনো ও পরিচিত প্রার্থীরাও মাঠে নামতে পারছেন না।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সমস্যার সৃষ্টি করছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় নতুন প্রার্থীরাও সাহস পাচ্ছেন না। এমতাবস্থায় জাতীয় পার্টি এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে, যেখানে নেতৃত্ব সংকট, প্রতীক সংকট, রাজনৈতিক ভাবমূর্তির সংকট, রাষ্ট্রীয় উপেক্ষা—সব মিলিয়ে দলটি অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে পড়েছে।