ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থীরা কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করতে পারবে

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনফাইল ছবি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এবারের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১২ জন নারী প্রার্থী দিয়েছে বামপন্থী সাতটি ছাত্রসংগঠনের প্যানেল প্রতিরোধ পর্ষদ। সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে নেওয়া প্রার্থী আছেন চারজন।

সব মিলিয়ে ২৮টি পদের বিপরীতে প্রতিরোধ পর্ষদ ১৬টি পদে প্রার্থী নিয়েছে নারী, সংখ্যালঘু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী থেকে। এর বাইরে একজন রয়েছেন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন।

প্রতিরোধ পর্ষদের স্লোগান রাখা হয়েছে ‘সমতায়-প্রতিরোধে নিরাপদ ক্যাম্পাস’। বামপন্থীরা মনে করছে, বৈচিত্র্য, প্রার্থীদের পরিচিতি এবং সব সময় তাঁদের প্রতিবাদী ভূমিকা ভোটে ভালো করতে সহায়তা করবে। প্রশ্ন হলো, বামপন্থীরা কি ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারবে?

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে অনুষ্ঠিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভালো করেছিল বামপন্থীরা।
আরও পড়ুন

বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে অনুষ্ঠিত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভালো করেছিল বামপন্থীরা। ওই সময় ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ছিল ছাত্রদের সবচেয়ে বড় দুই সংগঠন। স্বাধীনতার পরে ছাত্রলীগ ভেঙে ছাত্রলীগ ও জাসদ ছাত্রলীগ নামে দুটি সংগঠন হয়। এর মধ্যে ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন, যা এখন নিষিদ্ধ। আর জাসদ ছাত্রলীগ জাসদের ছাত্রসংগঠন।

১৯৬৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছে। বামধারার ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী চারবার ভিপি ও চারবার জিএস পদে জয়ী হয়েছেন। জাসদ ছাত্রলীগের প্রার্থী দুবার এবং বাসদ ছাত্রলীগের (এখন বিলুপ্ত) প্রার্থী একবার ভিপি পদে জিতেছেন। জিএস পদে বাসদ ছাত্রলীগ দুবার ও জাসদ ছাত্রলীগ একবার জয়ী হয়েছেন।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থীরা ভালো করতে পারেনি। যদিও ওই নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত।

১৯৬৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ১৩ বার ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন হয়েছে। বামধারার ছাত্রসংগঠনের মধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী চারবার ভিপি ও চারবার জিএস পদে জয়ী হয়েছেন।
সাতটি বামপন্থী সংগঠন মিলে গঠন করা হয়েছে প্রতিরোধ পর্ষদ
ছবি: দীপু মালাকার

বামদের দুই প্যানেল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন সক্রিয় বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ১০টি। এর মধ্যে সাতটি বামপন্থী সংগঠন মিলে গঠন করেছে প্রতিরোধ পর্ষদ। সংগঠনগুলো হলো ছাত্র ইউনিয়ন (তামজিদ-শিমুল), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী), বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিল, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (ইউপিডিএফ), ছাত্র ফেডারেশন (জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল) ও বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলন।

বামপন্থী তিনটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে ‘অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪’ নামে একটি প্যানেল দেওয়া হয়েছে। সংগঠন তিনটি হলো ছাত্র ইউনিয়ন (মাহির-বাহাউদ্দিন), সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ) ও বিসিএল (বাংলাদেশ জাসদ)। তবে বামপন্থীদের প্যানেলের মধ্যে প্রতিরোধ পর্ষদই বেশি আলোচনায় আছে।

প্রতিরোধ পর্ষদের সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) প্রার্থী জাবির আহমেদ জুবেল প্রথম আলোকে বলেন, নারী, পুরুষ, আদিবাসী, বাঙালি মিলিয়ে আমাদের প্যানেল করা হয়েছে, যাঁরা সবাই বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ধারণ করেন। তাঁরা বিভিন্ন সময়ে ক্যাম্পাসে প্রতিরোধের সামনের সারিতে ছিলেন এবং নিজ নিজ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ।

প্রতিরোধ পর্ষদ প্যানেলে শেখ তাসনিম আফরোজকে (ইমি) ভিপি পদে প্রার্থী করা হয়েছে। তিনি সরাসরি কোনো ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে তিনি শামসুন নাহার হল সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলোর সূত্র জানিয়েছে, বামপন্থীদের বাইরের শিক্ষার্থীদের নিয়ে প্যানেল গঠনের উদ্দেশ্য থেকেই শেখ তাসনিম আফরোজকে ভিপি প্রার্থী করা হয়েছে।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে বামপন্থীরা ভালো করতে পারেনি। যদিও ওই নির্বাচন ছিল চরম বিতর্কিত।
বামপন্থী তিনটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে ‘অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪’ নামে প্যানেল দেওয়া হয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

প্রতিরোধ পর্ষদের জিএস প্রার্থী মেঘমল্লার বসু ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। প্রতিবাদী ভূমিকা রাখতে গিয়ে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি কয়েক দফা ছাত্রলীগের হামলার শিকার হয়েছেন। ভালো বিতার্কিক হিসেবেও তিনি পরিচিত।

মেঘমল্লার গতকাল মঙ্গলবার এক ফেসবুক পোস্টে জানান, তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তাঁর অস্ত্রোপচার হবে। কয়েক দিন ক্যাম্পাসে সরাসরি প্রচার থেকে তাঁকে বিরত থাকতে হবে।

এজিএস পদে প্রার্থী জাবির আহমেদ জুবেল বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সাধারণ সম্পাদক। ক্যাম্পাসে তিনিও প্রতিবাদী মুখ হিসেবে পরিচিত। প্যানেলে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে মোজাম্মেল হক, যিনি সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক। কমনরুম, রিডিংরুম ও ক্যাফেটেরিয়া সম্পাদক পদে নূজিয়া হাসিন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি। তাঁরা দুজনই ক্যাম্পাসে পরিচিত মুখ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এখন সক্রিয় বামপন্থী ছাত্রসংগঠন ১০টি। এর মধ্যে সাতটি বামপন্থী সংগঠন মিলে গঠন করেছে প্রতিরোধ পর্ষদ।
আরও পড়ুন

প্রতিবাদী ভূমিকাই সামনে আনছেন প্রার্থীরা

ডাকসুর ভোটে এবার একটি ‘ফ্যাক্টর’ (নির্ধারক বিষয়) হলো, কারা ছাত্রলীগের নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে কার কী ভূমিকা ছিল। জুলাই অভ্যুত্থানের আগে ছাত্রলীগের নির্যাতন ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অন্যায়-অনিয়মের বিরুদ্ধে সব সময় প্রতিবাদী ভূমিকায় ছিল বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো।

প্রতিরোধ পর্ষদের চারজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই প্রতিবাদী ভূমিকাকে কাজে লাগাতে চায় প্রতিরোধ পর্ষদ। প্রার্থীরা তাঁদের ওপর হওয়া ছাত্রলীগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হামলার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের পক্ষে অবস্থানের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অবস্থানও তারা কাজে লাগাতে চায়।

চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, সন্ত্রাস ও নির্যাতনের অভিযোগ না থাকা এবং ব্যক্তি ও নারী স্বাধীনতার পক্ষে অবস্থান—এসব বিষয়কে নিজেদের শক্তির দিক বলে মনে করেন প্রতিরোধ পর্ষদের নেতারা। তবে তাঁরা বলছেন, ডাকসুর ভোটের প্রচারে অনেকে অনেক টাকা খরচ করছেন। সেটা তাঁরা করতে পারছেন না, করার চেষ্টাও করছেন না।

নিজেদের যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি না থাকাকেও চ্যালেঞ্জ মনে করছেন কেউ কেউ। তবে দুজন প্রার্থী বলেন, সংগঠনের বাইরের অনেকেই তাঁদের সমর্থন দিচ্ছেন। পাশাপাশি তাঁদের প্রার্থীরা ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ। সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভোট তাঁরা পাবেন বলে মনে করেন। তবে এ ক্ষেত্রে ‘ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের’ আশঙ্কার কথা বলছেন তাঁরা।

প্রতিরোধ পর্ষদের দুজন প্রার্থী বলেন, ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা কম রাখা হয়েছে। এতে ৪০ হাজারের মধ্যে ২০ হাজার ভোট নেওয়া সম্ভব হতে পারে। দীর্ঘ সময় লাগলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ভোট দিতে আগ্রহী হবেন না। এতে কোনো কোনো প্যানেল সুবিধা পেতে পারে। এটাকে তাঁরা বলছেন ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগগুলোর বিষয়েও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে দাবি করছেন প্রতিরোধ পর্ষদের প্রার্থীরা।

বামপন্থী তিনটি ছাত্রসংগঠনের উদ্যোগে ‘অপরাজেয় ৭১ ও অদম্য ২৪’ নামে একটি প্যানেল দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন

‘লড়াই চলবে’

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ভোট গ্রহণ হবে ৯ সেপ্টেম্বর। প্রতিরোধ পর্ষদের নেতারা বলছেন, নির্বাচনে তাঁদের ফলাফল যা-ই হোক, প্রতিবাদী ভূমিকা বজায় থাকবে। নির্বাচনে জয় বা পরাজয়ের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

প্রতিরোধ পর্ষদের প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নেওয়া মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন সম্পাদক পদে প্রার্থী মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ফ্যাসিবাদী আমলে তাঁরা যে লড়াই করেছেন, ডাকসু নির্বাচন সেই লড়াইয়েরই ধারাবাহিকতা। নির্বাচনের পরও যেকোনো ক্ষেত্রে তাঁদের লড়াই চলবে।

আরও পড়ুন