সমন্বয়হীনতায় বিএনপিতে হতাশা

মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যে আত্মসমালোচনা আছে। নেতা-কর্মীরা মাঠে সেভাবে দৃশ্যমান নয়, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়।

বিএনপি

২৮ অক্টোবর ঢাকায় নয়াপল্টনের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর থেকে ১০ দফায় ২০ দিন অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। এর পাশাপাশি দলটি তিন দফায় চার দিন হরতাল করেছে। গত দেড় মাসে ধারাবাহিকভাবে চলা এই কর্মসূচিতে এরই মধ্যে ‘ঢিলেঢালা’ ভাব দেখা দিয়েছে।

ভোটের দিন যতই এগিয়ে আসছে, নেতা-কর্মীদের মধ্যে হতাশা ততই বাড়ছে। কর্মসূচি নির্ধারণে সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। বিএনপিদলীয় সূত্রগুলো বলছে, এরপরও ভোট পর্যন্ত শক্ত কর্মসূচিতেই থাকবে বিএনপি।

আজ মঙ্গলবার সকাল ছয়টা থেকে আবার সারা দেশে ৩৬ ঘণ্টার অবরোধের কর্মসূচি দিয়েছে বিএনপি। আগামীকাল বুধবার সন্ধ্যা ছয়টায় এই কর্মসূচি শেষ হবে। এটি হবে দলটির ১১ দফায় ২২ দিনের অবরোধ কর্মসূচি।

বিএনপি শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। আর সরকার শুরু থেকেই আমাদের ওপর হামলা, মামলা, সহিংসতা করে আসছে।
সেলিমা রহমান, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য

বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, সরকারের নানামুখী নিপীড়নের কারণে কর্মসূচিতে কিছুটা শিথিলতা আসতে পারে। তবে এখনো সময় পার হয়ে যায়নি। ৭ জানুয়ারি ভোটের দিন পর্যন্ত সময় আছে। সে পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যেতে পারলে একটা ফল আসবেই। এখন দরকার দলীয় ঐক্য ও সংহতি ধরে রেখে এগিয়ে যাওয়া। এ ক্ষেত্রে সরকারের এত চাপ ও প্রলোভনের মধ্যেও দল ভাঙতে না পারার বিষয়টি নেতাদের আশাবাদী করছে।

আরও পড়ুন

রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. এরশাদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলন-কর্মসূচিতে আমরা প্রমাণ করেছি, জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। সরকারের যদি ন্যূনতম লজ্জা বা জনগণের প্রতি মায়া থাকত, তাহলে পদত্যাগ করত। কিন্তু তারা পুলিশ দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আমি বিশ্বাস করি, যতই নিপীড়ন করুক, একসময় আমরাই জয়ী হব। কারণ, জনগণ এখনো আমাদের সঙ্গেই আছে।’

তবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, আন্দোলন কর্মসূচির এ পর্যায়ে দলের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের অনেকের মধ্যে আত্মসমালোচনাও আছে। কারণ, দেড় মাসের কর্মসূচিতে নানা সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পেয়েছে। স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ বিভিন্ন পর্যায়ের অধিকাংশ দায়িত্বশীল নেতা গ্রেপ্তার–আতঙ্কে আত্মগোপনে চলে গেছেন। মূল দল বিএনপির নেতা-কর্মীরা মাঠে সেভাবে দৃশ্যমান নয়, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়।

আন্দোলন-কর্মসূচিতে আমরা প্রমাণ করেছি, জনগণ বিএনপির সঙ্গে আছে। সরকারের যদি ন্যূনতম লজ্জা বা জনগণের প্রতি মায়া থাকত, তাহলে পদত্যাগ করত। কিন্তু তারা পুলিশ দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চায়। আমি বিশ্বাস করি, যতই নিপীড়ন করুক, একসময় আমরাই জয়ী হব। কারণ, জনগণ এখনো আমাদের সঙ্গেই আছে
রাজশাহী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক মো. এরশাদ আলী

হরতাল-অবরোধের কর্মসূচির ওপর নজর রাখছেন, বিএনপির এমন নেতারা জানিয়েছেন, মূলত কর্মসূচিগুলো করছে যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল। মূল দল বিএনপিকে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না।

দলের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি নিয়ে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কিছুটা চিন্তিত। এর কারণ বের করে জেলার মূল নেতা-কর্মীদের কর্মসূচিতে আরও সক্রিয় করতে দুজন নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা হলেন বিএনপির ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম (বকুল) ও যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন। ইতিমধ্যে তাঁরা ঢাকা মহানগরসহ প্রায় সব সাংগঠনিক জেলার বিএনপি এবং অঙ্গসংগঠনের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ভার্চ্যুয়ালি কথা বলেছেন। এরপর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও সব বিভাগীয় সাংগঠনিক ও সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং জেলার শীর্ষ দুই নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান আন্দোলনে ‘ভালো খবর’ আছে জানিয়ে মাঠের নেতাদের দৃঢ়ভাবে আশ্বস্ত করেছেন। বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা মাঠপর্যায়ের নেতাদের স্মরণ করিয়ে দেন যে সরকার ৭ জানুয়ারির নির্বাচন সহজভাবে পার হয়ে গেলে কেউই পার পাবে না। সবার সাজা হয়ে যাবে। তখন জেলে থেকে মরা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না।

যদিও ভিন্নমত জানিয়ে বিএনপি ও জোটের অন্য নেতারা বলছেন, মহাসমাবেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী উপস্থিত হলেও পরের দিনের হরতালে তাদের কাজে লাগানো যায়নি নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা ও পূর্বপরিকল্পনার অভাবে।

যদিও জেলার নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের এড়িয়ে দলের ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক ও যুবদলের সভাপতিকে দায়িত্ব দেওয়ায় অনেকে মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন বলে জানা গেছে। আবার কোথাও কোথাও কেবল জেলার দুই নেতার সঙ্গে কথা বলায় কমিটির অন্যরা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন।

জানা গেছে, বিএনপির চলমান আন্দোলন-কর্মসূচির কৌশল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের মধ্যেও ভিন্নমত আছে। অনেক দল মনে করে, বিএনপির নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা এবং বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনার ছকের অভাবে আন্দোলন মার খাচ্ছে। তাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ নিয়ে বিএনপির কয়েক ধাপের যে পরিকল্পনা থাকা দরকার ছিল, তা ছিল না। মহাসমাবেশের নিরাপত্তার বেষ্টনীর জন্য কাকরাইল-বিজয়নগর এলাকায় যে পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক রাখার দরকার ছিল, তা রাখা হয়নি। আবার এ ধরনের পরিস্থিতির জন্য পূর্বপ্রস্তুতিও ছিল না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে মহাসমাবেশ নিয়ে সতর্ক করেছিলাম। বলেছিলাম, সরকার কর্মসূচি পণ্ড করে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ পণ্ড করে দিয়ে সেটি বিএনপির দিকে ঠেলে দিতে পারে। হয়েছে তার উল্টো।’

অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান গত রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিএনপি শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। আর সরকার শুরু থেকেই আমাদের ওপর হামলা, মামলা, সহিংসতা করে আসছে। মহাসমাবেশ পণ্ড করে, সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করে তারা নিজেরা নিজেরা একটা নির্বাচন করবে, এই পরিকল্পনা করেই তারা সেটা করেছে। এখানে বিএনপির নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা বা কোনো দুর্বলতা নেই।’

যদিও ভিন্নমত জানিয়ে বিএনপি ও জোটের অন্য নেতারা বলছেন, মহাসমাবেশে লাখ লাখ নেতা-কর্মী উপস্থিত হলেও পরের দিনের হরতালে তাদের কাজে লাগানো যায়নি নেতৃত্বের সমন্বয়হীনতা ও পূর্বপরিকল্পনার অভাবে। অন্যদিকে, সরকার কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে পরবর্তী কর্মসূচিতে একটা ভীতি সৃষ্টি করে এর ফল নেয়। কার্যত সরকারের পাতানো ফাঁদে পা দেয় বিএনপি। যার রেশ এখনো টানতে হচ্ছে।

বিএনপিদলীয় সাবেক সংসদ সদস্য ও খুলনার বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মনে হয়েছে, সরকার যে একটা ফাঁদ তৈরি করেছিল, সেদিকে লক্ষ রাখেনি বিএনপি। না বুঝে সরকারের সে ফাঁদে দিয়েছে। এখন মূল্যায়ন করা দরকার, আন্দোলন ও নির্বাচন একসঙ্গে থাকা উচিত ছিল কি না। শুধু বিদেশনির্ভরতা না করে আরও বিকল্প উপায় রাখা উচিত ছিল কি না। এখনকার পরিস্থিতি থেকে অবশ্যই বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে বড় ধরনের সংকটে পড়বে।’