বিএনপিকে ভোটের পরও চাপে রাখতে চায় আওয়ামী লীগ 

আওয়ামী লীগ ও বিএনপি

টানা চতুর্থ মেয়াদে সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক দিক থেকে এ মুহূর্তে তেমন হুমকি দেখছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে বিএনপিকে ছাড় না দিয়ে চাপে রাখার অবস্থান বহাল রাখবে তারা। 

দেশের ভেতরে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিষয় মাথায় থাকলেও এখন দ্রব্যমূল্য কমানো ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বেশি মনোযোগী ক্ষমতাসীনেরা। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের বিভিন্ন দেশের সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন কমিয়ে আনাও তাদের লক্ষ্য।

খড়্গ হিসেবে বিএনপির নেতাদের মাথার ওপর থাকা মামলার পাহাড় কাজে লাগানো হবে। একে একে শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাজা দেওয়ার সংখ্যা বাড়ালে দলটি রাজপথে হুমকি হতে পারবে না—এমন চিন্তা তাদের রয়েছে।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কারও কারও মত ছিল, ‘সন্ত্রাসী’ দল আখ্যা দিয়ে বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক। তবে বিএনপিসহ বিরোধীদের বর্জনের মধ্যে অনেকটা নির্বিঘ্নে ভোট সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার গঠন করে এখন আগামী পাঁচ বছরের জন্য নিশ্চিন্ত হতে চাইছে আওয়ামী লীগ। ফলে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে, সেই ক্ষোভ কমাতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামলাতে নজর বাড়ানোর কথা বলছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা। 

আরও পড়ুন

যদিও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বিএনপি শিগগিরই রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে সরকারকে চাপে ফেলতে পারবে না; কিন্তু এরপরও সরকারের জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে, এমন আভাস পাওয়া গেলে বিএনপির ওপর চাপ বাড়ানো হবে। এ ক্ষেত্রে খড়্গ হিসেবে বিএনপির নেতাদের মাথার ওপর থাকা মামলার পাহাড় কাজে লাগানো হবে। একে একে শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সাজা দেওয়ার সংখ্যা বাড়ালে দলটি রাজপথে হুমকি হতে পারবে না—এমন চিন্তা তাদের রয়েছে।

জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে নিষিদ্ধ হতে পারে; কিন্তু বিএনপির প্রতি দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর সমর্থন আছে। হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা ভোট বর্জন করেছে। এরপরও তাদের নিষিদ্ধ করার চিন্তা আছে বলে আমার মনে হয় না। থাকলেও তা বাদ দিতে হবে। এমনকি বিএনপির যে সব নেতা-কর্মী নাশকতার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। 
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ

ভোটের পরও এরই মধ্যে বিএনপিকে চাপে রাখার ক্ষমতাসীনদের চিন্তার প্রকাশ দেখা গেছে। নতুন জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর দিনে গত ৩০ জানুয়ারি ঢাকাসহ সারা দেশে কালো পতাকা মিছিলের কর্মসূচি নিয়েছিল তারা। সেদিন ঢাকার সাতটি জায়গায় পুলিশের বাধার কারণে বিএনপি তাদের কর্মসূচি পালন করতে পারেনি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের অধিকাংশের মত হচ্ছে, বিএনপি এখন সংসদের বাইরে রয়েছে। এমন পটভূমিতে দলটিকে চাপে রাখতে হবে। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকলে বিএনপি এমনিতে ক্ষয়িষ্ণু, এমনকি নিঃশেষ হয়ে যাবে। 

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, জামায়াত যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে নিষিদ্ধ হতে পারে; কিন্তু বিএনপির প্রতি দেশের একটি বড় জনগোষ্ঠীর সমর্থন আছে। হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তারা ভোট বর্জন করেছে। এরপরও তাদের নিষিদ্ধ করার চিন্তা আছে বলে আমার মনে হয় না। থাকলেও তা বাদ দিতে হবে। এমনকি বিএনপির যে সব নেতা-কর্মী নাশকতার সঙ্গে জড়িত নন, তাঁদের মুক্তির বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। 

সরকারের করণীয় সম্পর্কে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা আনা এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনকেন্দ্রিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে। তা আরও উন্নত করার চেষ্টা করতে হবে।  

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নতুন সরকারও তারেক রহমানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখবে। তারেক রহমানের অনুগত বিএনপির নেতারা মামলা ও সাজার ব্যাপারে কোনো ছাড় পাবেন না। বিএনপির ভেতরে অনেকেরই তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ আছে। এসব নেতার আস্তে আস্তে কারামুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। 

বিএনপির চেয়ে বড় হুমকি তারেক

বিএনপি আন্দোলনে সুবিধা করতে না পারলেও দলটির নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে। লন্ডন থেকেই দল পরিচালনা করছেন তিনি। তারেক রহমানের এই নিয়ন্ত্রণই মেনে নিতে রাজি নয় আওয়ামী লীগ। এ জন্য যেকোনো মূল্যে তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীকে ক্ষমতার বাইরে রাখা অবশ্য কর্তব্য মনে করেন ক্ষমতাসীনেরা। 

তারেক ও জামায়াতকে ক্ষমতার দূরে রাখার আওয়ামী লীগের চাওয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্বার্থ মিলে গেছে। এর ফলে গত ১৫ বছর কখনো বিএনপিকে ভোটের বাইরে রেখে, কখনো ভোটে রেখেও ক্ষমতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাইরের দুনিয়ায় বড় সমালোচনায় পড়তে হয়নি আওয়ামী লীগকে। এবার পশ্চিমা দুনিয়া থেকে চাপে পড়লেও ভারত কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ায় তারা বাংলাদেশের সরকারের পক্ষে জোরালোভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। ভোটের আগে যা খুবই প্রয়োজনীয় ছিল বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। 

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, নতুন সরকারও তারেক রহমানের ব্যাপারে কঠোর অবস্থান অব্যাহত রাখবে। তারেক রহমানের অনুগত বিএনপির নেতারা মামলা ও সাজার ব্যাপারে কোনো ছাড় পাবেন না। বিএনপির ভেতরে অনেকেরই তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে অসন্তোষ আছে। এসব নেতার আস্তে আস্তে কারামুক্তির সম্ভাবনা রয়েছে। 

আওয়ামী লীগের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির ওপর ১৫ বছর ধরে যে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছে, এর পেছনের মূল কারণ, তারেক রহমানের নেতৃত্ব। আরেকটি কারণ হচ্ছে জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির জোট।  এই নেতা আরও বলেন, ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে গঠিত চারদলীয় জোট একদিকে দেশের রাজনীতিতে ভারসাম্য নষ্ট করেছে। অন্যদিকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ১০ ট্রাক অস্ত্রের চালান, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ—এমন ভীতিকর অবস্থা তৈরি হয়েছিল। 

মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের মত হচ্ছে, শাসনব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য আনতে না পারলে দেশের ভেতরে ক্ষোভ বাড়তে পারে। যা বিএনপি-জামায়াতকে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে সহায়তা করতে পারে।

পশ্চিমা দুনিয়ায় বন্ধু কমে যাওয়ায় ভাবনা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বে বন্ধু হারানোর চাপে ছিল আওয়ামী লীগ। পশ্চিমা দুনিয়ায় নিজেদের হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়াকে চ্যালেঞ্জ মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির চারজন নেতা ও দুজন মন্ত্রীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁদের মতে, ২০২১ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সমালোচনার চেয়ে সাফল্যের পাল্লাই ভারী ছিল। 

তখন আওয়ামী লীগের সরকার মানে বহির্বিশ্বে অর্থনীতির ‘মিরাকল’ বিবেচনা করা হতো। আর শেখ হাসিনাকে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সাহসী শাসক হিসেবে দেখা হতো। গত পাঁচ বছরে অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব গণমাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন ও সরকার নিয়ে যে নেতিবাচক খবর বেরিয়েছে, তা কিছুটা চিন্তার। এবার নির্বাচনের আগে বিশ্ব গণমাধ্যমে আওয়ামী লীগের সরকারকে নিপীড়ক হিসেবে দেখানো হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশকে একদলীয় শাসনব্যবস্থার দিকে নিয়ে যাওয়ার কথাও ফলাও করে ছাপা হয়েছে বিশ্ব গণমাধ্যমে। আর অর্থনীতির অর্জনও এখন বিশ্ব গণমাধ্যমে খুব একটা স্থান পায় না। 

মন্ত্রিসভার একজন সদস্যের মত হচ্ছে, শাসনব্যবস্থা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে ওঠা গুরুত্বপূর্ণ। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য আনতে না পারলে দেশের ভেতরে ক্ষোভ বাড়তে পারে। যা বিএনপি-জামায়াতকে আবার সরকারবিরোধী আন্দোলনে সহায়তা করতে পারে।

বিরোধী দল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলবে 

২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্ষমতার পাশাপাশি বিরোধী দলেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা থাকবেন—এই কথা বলে বিকল্প বিরোধী দল তৈরির চেষ্টা চালায় আওয়ামী লীগ; কিন্তু এই পরিকল্পনা এখনো সফলতা পায়নি। 

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে কোণঠাসা করে ফেলে আওয়ামী লীগ। একে একে দলটির আর্থিক ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়া হয়। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলন ও নির্বাচন বর্জনের পর বিএনপিও দুর্বল হয়ে পড়ে। তখন থেকেই বিএনপি-জামায়াতের বাইরে সমমনাদের বিরোধী দলে বসানোর চেষ্টা চালায় আওয়ামী লীগ। 

ক্ষমতাসীন দলের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, বিএনপির বাইরে বিরোধী দল তৈরির চেষ্টা এখনো অব্যাহত থাকবে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ বিষয়ে বলেন, যারা দেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাস করে না। রাজাকারদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়, তাদের নিশ্চয়ই সরকার কিংবা বিরোধী দলে প্রত্যাশা করে না মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তি। এটা আওয়ামী লীগের স্বাভাবিক চাওয়া। 

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র বলছে, বিএনপির বাইরে জাপা ও ১৪ দলের শরিকদের বিরোধী দলে বসাতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলগুলো এই সুযোগ কাজে লাগায়নি। ফলে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব তাদের ওপর কিছুটা বিরক্ত।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মাহবুব উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ক্ষমতাসীন দলকে এটা মনে রাখা উচিত, তাদেরও হয়তো একদিন বিরোধী দলে যেতে হতে পারে। সেভাবেই বিরোধী দলের সঙ্গে আচরণ করা উচিত। তিনি বলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে বিরোধী দলের মতামতকে আমলে নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। বর্তমান সংসদে সে অর্থে কার্যকর বিরোধী দল নেই। ফলে মাঠের বিরোধী দলকে সমালোচনা করার সুযোগ দিতে হবে।