বরিশাল সিটিতে হাসানাত ও খায়েরের আলিঙ্গনের পরও তৃণমূলে বিভেদ

বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচন ঘনিয়ে এলেও আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের বিভেদ কমেনি। বরং তা এখনো প্রকাশ্য।

বিভেদের বিষয়টি আরও আলোচনা তৈরি করেছে গত রোববারের দুটি ঘটনায়। ওই দিন বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে সিটি করপোরেশনের ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য শরীফ মো. আনিছুর রহমান অভিযোগ করেন, দলের প্রার্থী আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে পরাজিত করার লক্ষ্যে আর্থিক লেনদেন করা হচ্ছে।

আনিছুর রহমান কোনো কোনো নেতার নাম উল্লেখ করে তাঁরা দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করছেন বলে অভিযোগ করেন। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম জাহাঙ্গীর সম্পর্কেও নানা মন্তব্য করেন তিনি।

এরপর রোববার রাতেই শৃঙ্খলা ভঙ্গ ও মিথ্যাচারের অভিযোগে আনিছুরকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
তালুকদার মো. ইউনুস, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক

এই দুই ঘটনা ঘটল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ও তাঁর ভাই মেয়র প্রার্থী খায়ের আবদুল্লার আলিঙ্গনের এক দিন পর। আগের দিন শনিবার গৌরনদীতে এক সভায় দুই ভাই আলিঙ্গন করেন। এর মাধ্যমে সিটি নির্বাচনে মনোনয়নকে কেন্দ্র আওয়ামী লীগের মধ্যে তৈরি হওয়া বিরোধ দূর হবে বলে আশা করা হয়েছিল।

বরিশাল সিটি নির্বাচনের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতা, রাজনীতিসচেতন ব্যক্তি ও সাধারণ ভোটারদের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের মধ্যে যে বিভেদ ও অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে, তা দূর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এই বিভেদ দলের প্রার্থীর ক্ষতি করবে।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে দলের একাংশের কারণে বেকায়দায় পড়তে হয়েছে। তিনি ভোটে হেরে গেছেন।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে এবার দলীয় মনোনয়ন পাননি বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ, যিনি আবুল হাসানাত আবদুল্লার বড় ছেলে। মনোনয়ন পান সাদিকের ছোট চাচা আবুল খায়ের আবদুল্লাহ। এতে শুরু থেকেই হাসানাত আবদুল্লাহ ও সাদিকের অনুসারী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা দলীয় প্রার্থীর ব্যাপারে নির্লিপ্ত ছিলেন।

সবকিছুই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে এবং সেটার সরাসরি প্রভাব পড়বে দলীয় মেয়র প্রার্থীর ওপর।
মীর আমিন উদ্দীন, খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য

আওয়ামী লীগে বিরোধ মেটাতে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ এবং দুই ভাইয়ের আলিঙ্গনের পর সাদিকের অনুসারীরা নিজেদের মতো করে নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন, লিফলেট বিতরণ করছেন। তবে প্রচারে খায়ের আবদুল্লাহর পাশে তাঁদের দেখা যাচ্ছে না।

বরিশাল সিটি নির্বাচনে খায়ের আবদুল্লাহ শক্তিশালী প্রার্থী। তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী কে হবেন, সেটা নিয়েই বেশি আলোচনা হয় বরিশালে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মুফতি ফয়জুল করিম, জাতীয় পার্টির (জাপা) ইকবাল হোসেন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাত্রদলের সাবেক নেতা কামরুল আহসান ওরফে রূপণ আলোচনায় আছেন। অবশ্য দলের বিভেদ ও ভোটব্যাংক হিসাব-নিকাশ উল্টেও দিতে পারে।

‘এঁরা টাকা পান কোথায়’

কাউন্সিলর প্রার্থী আনিছুর রহমান রোববারের সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, তিনিসহ সিটি করপোরেশনের বর্তমান পরিষদের ১০ জন কাউন্সিলর বর্তমান মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষ ত্যাগ করে দূরে চলে যাওয়ায় তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে এবারের নির্বাচনে দল থেকে কাউন্সিলর প্রার্থী দাঁড় করানো হয়েছে।

এরপরই রাত পৌনে একটায় আনিছুর রহমানকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করে মহানগর আওয়ামী লীগ। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ করায় তাঁর বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।

তবে বহিষ্কারের বিষয়ে আনিছুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সত্য বলায় আমাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আমরা যে ১০ জন কাউন্সিলর মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষ ত্যাগ করেছিলাম, সেই ১০টি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে আমাদের জব্দ করার জন্য।’ তিনি প্রশ্ন করেন, এঁরা নির্বাচন করার টাকা পান কোথায়? তাঁদের আসল উদ্দেশ্য কী?

১০ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধেই প্রার্থী

২০১৮ সালের নির্বাচনে বরিশাল সিটির ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে ২৪টিতে জয়ী হন আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থীরা। ২০২১ সালে বরিশাল সদরের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবনে মেয়র সমর্থকদের হামলার পর পরিস্থিতি পাল্টাতে শুরু করে। ১০ কাউন্সিলর মেয়রের পক্ষ ত্যাগ করেন। তাঁরা যোগ দেন সদর আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের পক্ষে।

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রক্রিয়ার শুরু থেকেই এই ১০ কাউন্সিলর খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁদের সবার বিরুদ্ধে সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারীদের প্রার্থী করা হয়েছে বলে অভিযোগ খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষের নেতা-কর্মীদের।

আমি সত্য বলায় আমাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। আমরা যে ১০ জন কাউন্সিলর মেয়র সাদিক আবদুল্লাহর পক্ষ ত্যাগ করেছিলাম, সেই ১০টি ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী করা হয়েছে আমাদের জব্দ করার জন্য।
আনিছুর রহমান, কাউন্সিলর প্রার্থী

অবশ্য জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস প্রথম আলোকে বলেন, এবার দল থেকে কাউকেই কাউন্সিলর পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। ৩০টি ওয়ার্ডেই দলীয় নেতা-কর্মীরা যে যাঁর মতো প্রার্থী হয়েছেন। এখানে কারও ইন্ধনের প্রশ্নই আসে না।

এই ১০ কাউন্সিলরের নেতৃত্বে ছিলেন ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর জিয়াউল হক (বিপ্লব)। তাঁর বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ জেলা ছাত্রলীগ সহসভাপতি ওবায়দুল হক, যিনি সাজ্জাদ সেরনিয়াবাত নামে পরিচিত। ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ আহমেদের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইমরান মোল্লা, ২৮ নম্বর ওয়ার্ডে জাহিদ হোসেনের বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা হ‌ুমায়ূন কবীর ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর হ‌ুমায়ূন কবিরের বিরুদ্ধে শফিকুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন।

২৪ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর শরীফ আনিছুর রহমানের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সফিন মাহমুদ তারিক, ১ নম্বর ওয়ার্ডে আমির হোসেন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান মেনন, ১২ নম্বর ওয়ার্ডে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে আনোয়ার হোসেন, ৪ নম্বর ওয়ার্ডে তৌহিদুল আলমের বিরুদ্ধে সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সৈয়দ সামসুদ্দোহা এবং ২২ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর আনিছুর রহমান দুলালের বিরুদ্ধে আশ্রাফ খান প্রার্থী হয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবাই সাদিক আবদুল্লাহর অনুসারী বলে পরিচিত।

২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হকের বিরুদ্ধে সাদিকপন্থী প্রত্যক্ষ প্রার্থী নেই। তবে সাবেক কাউন্সিলর রউফুল আলমের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন সাদিক অনুসারীরা।

দলীয় সূত্র জানায়, এই ১০টি ওয়ার্ড ছাড়া অন্য ওয়ার্ডেও সাদিক ও জাহিদ ফারুকপন্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। আবার কোথাও কোথাও সাদিকপন্থীরা পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রার্থী হয়েছেন। সব মিলিয়ে অবস্থাটা এই যে মেয়র প্রার্থী খায়ের আবদুল্লাহ মাঠে পাচ্ছেন দলের বিভক্ত সাংগঠনিক শক্তিকে।

অথচ ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে বরিশালে ৩০টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অলিখিতভাবে প্রার্থী ঠিক করে দেওয়া হয়েছিল। সবার মার্কা ছিল ঠেলাগাড়ি।

১২ জুন বরিশাল সিটিতে নির্বাচন। খায়ের আবদুল্লাহর নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য মীর আমিন উদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, সবকিছুই বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে করা হচ্ছে এবং সেটার সরাসরি প্রভাব পড়বে দলীয় মেয়র প্রার্থীর ওপর।