১৪–দলীয় জোট: এবারও নৌকা প্রতীক চায় শরিক দলগুলো

  • আওয়ামী লীগ জোটগতভাবে নির্বাচন করার কথা জানিয়েছে ইসিকে।

  • ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদসহ ছয়টি শরিক দল নৌকা প্রতীকে ভোট করার চিঠি দিয়েছে।

  • শরিকেরা নৌকা প্রতীক নিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জয় নিশ্চিত করতে চায়।

নৌকা প্রতীক

এবারও আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন পাড়ি দিতে চায় ১৪–দলীয় জোটের শরিকেরা। ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বাধীন এই জোটের শরিকেরা আসন ভাগাভাগির সমঝোতায় যে আসনগুলো পাবে, সেগুলোতে তারা নৌকায় ভোট করবে। শরিকেরা নৌকা প্রতীক নিয়ে তাদের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের জয় নিশ্চিত করতে চায়। এর বাইরে নিজস্ব প্রতীকেও কিছু প্রার্থী দেবে শরিক দলগুলো।

আওয়ামী লীগ ও ১৪-দলীয় জোটের শরিকদের সূত্রে এই তথ্য জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, বিএনপি নির্বাচনে আসছে না, এটা ধরে নিয়েই আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকেরা এখন ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছে। তবে আসন ভাগাভাগির প্রশ্নে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু না হলেও জোটের শরিকেরা আগের নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবার অনেক বেশি অর্থাৎ ১০০টির মতো আসন চাইতে পারে।

আরও পড়ুন

নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে ভোট করার কথা জানিয়ে ১৪ দলের শরিকেরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠিও দিয়েছে। গতকাল শনিবার ইসির নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জোটের শরিকদের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলসহ (জাসদ) ছয়টি দল নির্বাচন কমিশনে (ইসি) চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে তারা জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে। এর অর্থ হচ্ছে, শরিকেরা নিজেদের প্রতীকের বাইরে নৌকা প্রতীকেও ভোট করতে পারবে।

আরও আছে বিকল্পধারা ও বিভিন্ন ইসলামি দল। এর বাইরে এবার যুক্ত হয়েছে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। বিএনপি থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন কেউ কেউ। ফলে এবার সমঝোতার তালিকা বড় হবে।

১৪ দলের শরিক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ২০১৮ সালের নির্বাচনে নিজেদের প্রতীক বাইসাইকেলে ভোট করে জয়ী হয়। অন্য শরিকেরা নৌকা ছাড়া নিজস্ব প্রতীকে ভোট করলেও সেগুলোতে জয়ী হতে পারেনি। এবার জেপিও আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করার কথা জানিয়ে ইসিকে চিঠি দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ ও ১৪–দলীয় জোটের সূত্রগুলো জানায়, ১৪ দলের বাইরে জাতীয় পার্টি (জাপা) শেষ পর্যন্ত ভোটে আসবে বলে তারা নিশ্চিত। জাতীয় পার্টির সঙ্গেও আসন সমঝোতা করতে হবে।

১৪ দলের শরিকেরা নৌকায় ভোট অতীতেও করেছে। এবারও হয়তো করবে। তবে আসন নিয়ে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ

আরও আছে বিকল্পধারা ও বিভিন্ন ইসলামি দল। এর বাইরে এবার যুক্ত হয়েছে ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে পরিচিত তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। বিএনপি থেকে বের হয়ে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন কেউ কেউ। ফলে এবার সমঝোতার তালিকা বড় হবে। এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ শরিক ও সমমনাদের জন্য ৭০টি আসন ছাড়ার কথা বিবেচনা করছে। এর মধ্যে জাতীয় পার্টিকে সবচেয়ে বেশি আসন ছাড়তে হতে পারে। তবে বিএনপি থেকে গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কেউ বেরিয়ে এলে ছাড় দেওয়া আসনের সংখ্যা বাড়তে পারে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ প্রথম আলোকে বলেন, ১৪ দলের শরিকেরা নৌকায় ভোট অতীতেও করেছে। এবারও হয়তো করবে। তবে আসন নিয়ে এখনো আলোচনা শুরু হয়নি।

বিএনপি ভোটে না এলে সমঝোতার বাইরে কিছু আসন উন্মুক্ত রাখা হতে পারে।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু

অবশ্য আওয়ামী লীগের অন্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, দলটি এবার সব মিলিয়ে যত আসন ছাড়ার চিন্তা করছে, তার চেয়ে বেশি আসন প্রত্যাশা করছে ১৪ দলের শরিকেরা। শরিকদের সঙ্গে কথা বলে যে ধারণা পাওয়া গেছে, তাতে তারা অন্তত শখানেক আসনের তালিকা দেবে। তবে আওয়ামী লীগ ১০-১২টি আসনের বেশি ১৪ দলের শরিকদের ছাড়তে রাজি নয় বলে ক্ষমতাসীন দলটির সূত্র জানিয়েছে।

আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানিয়েছে, মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর ১৪ দলের শরিকদের কাছ থেকে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকা চাওয়া হবে। প্রত্যাহারের শেষ সময়ে শরিকদের আসন নিশ্চিত করা হবে। শরিকদের আপত্তি থাকলে কিছু আসনে নিজেদের প্রতীকে ভোট করার পরামর্শ দেবে আওয়ামী লীগ।

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) সভাপতি হাসানুল হক ইনু প্রথম আলোকে বলেন, আসন সমঝোতা নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তিনি বলেন, বিএনপি ভোটে না এলে সমঝোতার বাইরে কিছু আসন উন্মুক্ত রাখা হতে পারে।

জোটের অতীত

সব দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১৩টি আসনে ১৪ দলের শরিকদের ছাড় দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে শরীফ নূরুল আম্বিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাসদ দুটি আসন পেয়েছিল। কিন্তু এখন দলটি ১৪–দলীয় জোটে নেই।

গত নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টি পাঁচটি আসনে নৌকা পেয়েছিল। এর মধ্যে দুটি আসনে তারা হেরে যায়। হাসানুল হক ইনুর জাসদ তিনটি আসন পেয়ে দুটিতে জয়ী হয়। তরীকত ফেডারেশন ও জেপি একটি করে আসন পেয়ে জয়ী হয়। জেপির মহাসচিব শেখ শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এবার নৌকা ও বাইসাইকেল দুই প্রতীকেই ভোট করার পরিকল্পনা নিয়েছেন।

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকদের সবচেয়ে বড় সাফল্য এসেছিল ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে। ওই নির্বাচন বর্জন করেছিল ক্ষমতাসীনদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। ১৫৩টি আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পেয়েছিলেন। একতরফা ওই নির্বাচনে ২৪টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৫টিতে জয় পেয়েছিল জাসদ। এর মধ্যে ৩টিতে জিতেছিল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। ওয়ার্কার্স পার্টি ১৮টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ৬টিতে জয় পেয়েছিল। এর মধ্যে ২টিতে তারা জয় পায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জেপি বাইসাইকেল প্রতীকে ২৮ আসনের মধ্যে ২টিতে জয় পেয়েছিল। তরীকত ফেডারেশন ৩টি আসনে প্রার্থী দিয়ে ২টিতে জয় পেয়েছিল। অন্য শরিকেরা কোনো আসন পায়নি।

দশম সংসদে শরিকদের প্রধান নেতাদের সমঝোতার মাধ্যমে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী করতে ভূমিকা রাখে আওয়ামী লীগ। আর কিছু আসন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আওয়ামী লীগের সহায়তায়।

২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৪ দলকে সঙ্গে নিয়ে জোটগতভাবে অংশ নিয়েছিল আওয়ামী লীগ। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের শরিক জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, তরীকত ফেডারেশন, গণতন্ত্রী পার্টি, সাম্যবাদী দল ও জেপি প্রার্থী দিয়েছিল। ওই নির্বাচনে শরিকেরা নৌকা এবং নিজেদের প্রতীকে ভোট করে।

শরিকদের মধ্যে সবচেয়ে সফল ছিল জাসদ। দলটি ৭ আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে ৪টিতে ভোট করেছিল নৌকা প্রতীকে। এর মধ্যে ৩টি আসনে জয় পেয়েছিল।

ওয়ার্কার্স পার্টির প্রার্থী ছিল ৫টি আসনে। এর মধ্যে ২টিতে নিজেদের প্রতীক হাতুড়ি এবং ৩টিতে আওয়ামী লীগের প্রতীক নৌকা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন প্রার্থীরা। ওই নির্বাচনে ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন বিজয়ী হয়েছিলেন। জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি যে ৫টি আসনে জয় পেয়েছিল, সেখানে তাদের প্রার্থীদের প্রতীক ছিল আওয়ামী লীগের নৌকা। তরীকত ফেডারেশন ও জেপি ১টি করে আসন পায়।

তরীকত ফেডারেশনের সভাপতি নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা ১৫টি আসন চাইবেন। আওয়ামী লীগ যে আসনগুলো দেবে, সেগুলোতে এবারও নৌকায় ভোট করবেন তাঁরা।

ইসিতে চিঠি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনসংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ অনুযায়ী, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ইচ্ছুক একাধিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল মিলে নির্বাচনী জোট গঠন করে নির্বাচন করতে পারে। জোটভুক্ত দলগুলো জোটের শরিক যেকোনো দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। এ ধরনের প্রতীক পেতে হলে জোটকে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন বরাবর আবেদন করতে হয়। গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে ইসি।

জোটভুক্তভাবে নির্বাচনের বিষয়টি ইসিকে জানানোর শেষ সময় গতকাল শনিবারের মধ্যে আওয়ামী লীগ ছাড়া ১৪-দলীয় জোটের শরিক যে দলগুলো জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করার বিষয়ে ইসিকে জানিয়েছে, সেগুলো হলো জাতীয় পার্টি (জেপি), জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ), বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল ও গণতন্ত্রী পার্টি। এর মধ্যে গণতন্ত্রী পার্টি দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ায় কোন অংশটি নিবন্ধিত, তা এখনো পরিষ্কার নয়। গণতন্ত্রী পার্টি দুই অংশই আলাদা চিঠি দিয়েছে।

এর বাইরে বিকল্পধারা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেবে বলে জানিয়েছে। তারা সুনির্দিষ্টভাবে নৌকা প্রতীক চায়নি।

গতকাল বিকেল চারটার কিছু আগে ইসির অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, আওয়ামী লীগের চিঠিতে বলা হয়েছে, তারা জোটগতভাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করবে। তবে তাদের সঙ্গে কোন কোন দল থাকবে, সেটা চিঠিতে বলা হয়নি।

ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হবে ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ১৭ ডিসেম্বর। প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর।