‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’: নিবন্ধন পেতে যাওয়া দল গঠনতন্ত্র দেখাতে চায় না

দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় এক কক্ষের। কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলা ও উপজেলা কমিটির তালিকাও দেখাতে চায় না দলটি।

সিঁড়ি ধরে কিছুটা ওপরে উঠতেই এক কক্ষের ছোট্ট একটি কার্যালয়। কক্ষের সামনের দেয়ালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’ লেখা ছোট ব্যানার টাঙানো আছেছবি: প্রথম আলো

নির্বাচন কমিশন যে দুটি দলকে নিবন্ধন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তার একটি ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’। নিবন্ধন আবেদনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানা ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার টানপাড়া আটি। যদিও টানপাড়া আটি নামের কোনো এলাকার অস্তিত্ব কেরানীগঞ্জে পাওয়া যায়নি। পরে দলটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, দলীয় কার্যালয়ের ঠিকানা পরিবর্তন করেছেন তাঁরা।

নতুন ঠিকানা মিরপুরের মাজার রোডের শহীদ নূর হোসেন টাওয়ারে বলেও জানান মাহবুবুল আলম। তাঁর দেওয়া ঠিকানায় গতকাল বুধবার দুপুরে যান প্রথম আলোর প্রতিবেদক। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, যেটিকে টাওয়ার বলা হচ্ছে, সেটি আসলে তিনতলা একটি ভবন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে কোনো দলের কার্যালয় রয়েছে। কোনো সাইনবোর্ডও নেই। ভবনের নিচতলার সামনের অংশে খাবারসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রাংশ বিক্রির দোকান। দ্বিতীয় তলার এক পাশে বেসরকারি একটি ব্যাংকের শাখা রয়েছে। অন্য পাশের ফ্ল্যাটটি বাসাবাড়ি হিসেবে ব্যবহার করার হয়। তৃতীয় তলাতেও কয়েকটি পরিবার থাকে।

কক্ষের ভেতরে আসবাব বলতে শুধু একটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার। টেবিলের পেছনের দেয়ালে কালো টেপ দিয়ে একটি ব্যানার (দলের নাম লেখা) সাঁটানো
ছবি: প্রথম আলো

ভবনের কোথাও কার্যালয় খুঁজে না পেয়ে দলটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে আবার যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। তিনি ১০ মিনিট অপেক্ষা করতে বলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ভবনের সামনে আসেন তিনি। পরে তাঁর সঙ্গে ভবনের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, নিচতলার ডান পাশে একটি সরু সিঁড়ি নিচের দিকে নেমে গেছে। ওই সিঁড়ি দিয়ে কয়েক ধাপ নামার পর ডান দিকে একটু এগোলে ওপরের দিকে যাওয়ার আরেকটি সিঁড়ি আছে। সেই সিঁড়ি ধরে কিছুটা ওপরে উঠতেই এক কক্ষের ছোট্ট একটি কার্যালয়। কক্ষের সামনের দেয়ালে ‘বাংলাদেশ জাতীয় লীগ’ লেখা ছোট ব্যানার টাঙানো আছে।

কক্ষের ভেতরে আসবাব বলতে শুধু একটি টেবিল আর কয়েকটি চেয়ার। টেবিলের পেছনের দেয়ালে কালো টেপ দিয়ে একটি ব্যানার (দলের নাম লেখা) সাঁটানো। এর বাইরে দলের দাপ্তরিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কোনো কম্পিউটার, প্রিন্টার, আলমারি, ফাইল কিংবা কাগজপত্র—কিছুই কক্ষে দেখা যায়নি।

গঠনতন্ত্র দেখানো যাবে না

গিয়ে দেখা যায়, যেটিকে টাওয়ার বলা হচ্ছে, সেটি আসলে তিনতলা একটি ভবন। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, ভেতরে কোনো দলের কার্যালয় রয়েছে
ছবি: প্রথম আলো

দলের গঠনতন্ত্রে কী লেখা আছে, তা দেখতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম বলেন, ‘গঠনতন্ত্রের কোনো হার্ডকপি কার্যালয়ে নেই। সফট কপি আপনাকে পরে পাঠিয়ে দেব।’

পরে গতকাল বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে মুঠোফোনে দলটির চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত হলো নিবন্ধনের গেজেট প্রকাশের আগপর্যন্ত আমরা কাউকে গঠনতন্ত্র দেখাব না।’

কেন্দ্রীয় কমিটি এবং জেলা ও উপজেলার কমিটির তালিকার বিষয়ে মুঠোফোনে মাহবুবুল আলম বলেন, ‘সবই আছে। নিবন্ধনের গেজেট প্রকাশের পর সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের সব কার্যক্রম প্রকাশ করব।’

নিবন্ধনের শর্ত

কোনো দল দলীয় প্রতীকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত হতে হয়। আর নিবন্ধন পেতে হলে ইসির বেশ কিছু শর্ত মানতে হয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কমিটিসহ একটি সক্রিয় কেন্দ্রীয় কার্যালয় থাকা, অন্তত এক-তৃতীয়াংশ প্রশাসনিক জেলায় কার্যকর জেলা কার্যালয় এবং অন্তত ১০০টি উপজেলায় কার্যালয় এবং প্রতিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তত ২০০ জন ভোটারের তালিকাভুক্তি থাকতে হয়।

এ ছাড়া কোনো দলের কেউ অতীতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকলে বা আগের কোনো নির্বাচনে ৫ শতাংশ ভোট পেলেও নিবন্ধন
পাওয়ার যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়। প্রধান এসব শর্তের সঙ্গে আরও কিছু নিয়মকানুন মেনে আবেদন করতে হয় দলকে।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইসিতে নিবন্ধনের জন্য ১৪৩টি দল আবেদন করেছিল। প্রাথমিক বাছাইয়ে ২২টি দল টিকেছিল, যেগুলোর বিষয়ে মাঠপর্যায়ে তথ্য যাচাই করে ইসি। এর মধ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জাতীয় লীগ নিবন্ধনের শর্ত পূরণ করেছে বলে গত মঙ্গলবার জানায় ইসি। শিগগিরই দল দুটি নিবন্ধন পেতে যাচ্ছে বলেও সেদিন সাংবাদিকদের জানান ইসি সচিব আখতার আহমেদ। এখন দল দুটির বিষয়ে কারও কোনো আপত্তি আছে কি না, জানতে চেয়ে বিজ্ঞপ্তি দেবে ইসি।

ইসির সিদ্ধান্তে নিবন্ধন পেতে যাওয়া জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয় বাংলামোটরের রূপায়ণ টাওয়ারের ১৬ তলায়। দলটির কার্যালয়ের দেয়ালে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের নানা গ্রাফিতি আঁকা। কার্যালয়ের ভেতরের সামনের অংশে সংবাদ সম্মেলন কিংবা সভা করার মতো আধুনিক ব্যবস্থা আছে। দলের আহ্বায়ক ও সদস্যসচিবের জন্য পৃথক কক্ষ আছে। এ ছাড়া শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বসার জন্য একাধিক কক্ষ আছে।

এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির শীর্ষ নেতারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ২১৬ সদস্যের। ঢাকার বাইরে বেশির ভাগ জেলায় দলটির কমিটি আছে। মহানগর, উপজেলা ও থানা পর্যায়েও কমিটি করেছে দলটি।

শর্ত পূরণের দাবি

গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ জাতীয় লীগের কার্যালয়ে দলটির চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের সঙ্গে যখন কথা হচ্ছিল, তখন তিনি দাবি করেন, নির্বাচন কমিশনের সব শর্ত পূরণ করেই তাঁরা নিবন্ধন পেতে যাচ্ছেন। এ ছাড়া তিনি দাবি করেন, সারা দেশে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার মতো সক্ষমতা তাঁদের রয়েছে। তবে এখনো প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারেননি, কাজ চলছে। তিনি নিজে পটুয়াখালীর দুটি আসন থেকে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও জানান।

চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথায় কথায় আরও জানা যায়, ২০১৭ ও ২০২২ সালেও নিবন্ধনের আবেদন করেছিল বাংলাদেশ জাতীয় লীগ। কিন্তু দুবারই নিবন্ধন দেওয়া হয়নি দলটিকে। এবার নিবন্ধন আবেদনে প্রতীক হিসেবে দলটি ‘কলার ছড়ি’ চেয়েছে। তবে এই প্রতীক এখন পরিবর্তন করতে চান দলটি। আর দলের স্লোগান ঠিক করা হয়েছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ’।

মাহবুবুল আলম বলেন, ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই বাংলাদেশ জাতীয় লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ মুহূর্তে ৫১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি রয়েছে। পাশাপাশি ৩০টি জেলা ও উপজেলায় কমিটি আছে তাদের। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে দলটির তৎকালীন শীর্ষ নেতা আতাউর রহমান খান ঢাকা-১৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনেও ঢাকা-২১ আসন থেকে আতাউর রহমান খান এবং কুমিল্লা-১৩ আসন থেকে অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

ইসির শর্তে অতীতে কোনো দল থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে নিবন্ধনে অগ্রাধিকার পাওয়ার কথা বলা আছে। সেই শর্ত উল্লেখ করেই নিবন্ধন আবেদন করেছে বাংলাদেশ জাতীয় লীগ।

চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলমের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন কাউসার হামিদ নামের এক যুবক। তাঁকে দলটির ঢাকা জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেন চেয়ারম্যান। তিনি জানান, তাঁদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের মাসিক ভাড়া ছয় হাজার টাকা।