অধিকাংশ পুরোনো মন্ত্রী বাদ গেলেন তিন কারণে

>
  • বয়সে প্রবীণ
  • নিজের ও পরিবারের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত
  • দক্ষ হাতে মন্ত্রণালয় চালাতে না পারা

বয়সে প্রবীণ, নিজের ও পরিবারের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত এবং দক্ষ হাতে মন্ত্রণালয় চালাতে না পারা—মোটাদাগে এই তিন কারণে বিদায়ী মন্ত্রিসভার অধিকাংশ সদস্য বাদ পড়েছেন। সরকার ও আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রের সঙ্গে কথা বলে এমন একটা ধারণা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি থাকা ও অপেক্ষাকৃত নতুনদের দিয়ে মন্ত্রিসভা করে একটা ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার চেষ্টাও আছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে বলা হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা বলেন, নতুন মন্ত্রিসভায় অপেক্ষাকৃত কম বয়সী অনেকের ঠাঁই হয়েছে, যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন। যেমন তুলনামূলক কম বয়সী দলটির তিনজন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদককে প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী করা হয়েছে।

বিদায়ী বাণিজ্যমন্ত্রী আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতা তোফায়েল আহমেদও গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, নতুনদের জায়গা করে দিতে হয়।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গতকাল মন্ত্রিসভার যে ৪৭ জন সদস্য গতকাল শপথ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ৩১ জনই নতুন। এর মধ্যে আবার ২৭ জন জীবনের প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় যুক্ত হলেন। আর সদ্য বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৪৮ জনের মধ্যে ৩৪ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে তফসিল ঘোষণার পর পদত্যাগ করা চার টেকনোক্র্যাট মন্ত্রীর মধ্যে দুজনকে এবারও মন্ত্রী করা হয়েছে, বাকি দুজন বাদ পড়েছেন। কয়েকজন বাদে গত মন্ত্রিসভার জ্যেষ্ঠদের প্রায় সবাই বাদ পড়েছেন। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আরও জানা যায়, জ্যেষ্ঠদের একজনকে বাদ দিলে আরেকজন যাতে প্রশ্ন না তুলতে পারেন, সে জন্য বাদ পড়ার সংখ্যা বেড়েছে।

পুরোনো বেশির ভাগ মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে নতুনদের যুক্ত করার বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হোসাইন বলেন, এমনটা হতেই পারে। তবে তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে অনীহা প্রকাশ করেন।

নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে গতকাল সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, ‘নতুন মন্ত্রিসভায় নবীন-প্রবীণ সবাই আছেন। তবে জ্যেষ্ঠদের বাদ দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী জানেন। আমি বলব, তাঁদের বাদ দেওয়া হয়েছে, এটা বলা ঠিক হবে না। তাঁদের দায়িত্ব পরিবর্তিত হয়েছে। তাঁরা দলে মনোনিবেশ করবেন।’

নতুন মন্ত্রিসভায় জ্যেষ্ঠ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসিম, রাশেদ খান মেনন, হাসানুল হক ইনু ও আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর মতো নেতারাও বাদ পড়েছেন।

বাদ পড়াদের মধ্যে আছেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ। তাঁরা নিজের বা পরিবারের সদস্যদের কর্মকাণ্ডের কারণে বিতর্কিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী এবার সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও পাননি।

এ ছাড়া বাদ পড়েছেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন, স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী মুহা. ইমাজউদ্দিন প্রামাণিক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী এ কে এম শাহজাহান কামাল। তাঁদের কারও কারও মন্ত্রণালয়ে কর্মকাণ্ড নিয়ে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা আছে। আবার কেউ কেউ বয়সের কারণেও বাদ পড়েছেন। কারও কারও মন্ত্রণালয়ের কাজেও গতি কম ছিল।

বিরোধী দলে থাকার ঘোষণা দেওয়া জাতীয় পার্টির মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীদের বাদে এবার প্রতিমন্ত্রীদের মধ্যে যাঁরা বাদ পড়েছেন, তাঁরা হলেন মির্জা আজম, বীরেন শিকদার, ইসমাত আরা সাদেক, মেহের আফরোজ, তারানা হালিম, মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ও কাজী কেরামত আলী। তাঁদের কারও কারও কর্মদক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। আবার কাউকে বাদ দিয়ে একই জেলার অন্যদের যুক্ত করা হয়েছে। যেমন জামালপুরের বাড়ি বস্ত্র ও পাট প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম বাদ পড়লেও ওই জেলার সরিষাবাড়ীর সাংসদ মুরাদ হাসানকে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ নজরুল ইসলামকে বাদ দিয়ে একই জেলা নরসিংদীর আরেক সাংসদ নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুনকে শিল্পমন্ত্রী করা হয়েছে। বিদায়ী জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেকের বাড়ি যশোরে। এবার ওই জেলার আরেক সাংসদ স্বপন ভট্টাচার্যকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে।

পুরোনো মন্ত্রিসভার উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম ও আরিফ খানও বাদ পড়েছেন। এর মধ্যে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়া সাবেক ফুটবলার আরিফ খান এবার সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নও পাননি। নেত্রকোনা–২ আসনের তাঁর পরিবর্তে এবার মনোনয়ন পেয়ে সাংসদ হন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশরাফ আলী খান। তাঁকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী করা হয়েছে। আবার মেহেরপুর থেকে প্রথমবারের মতো মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন ফরহাদ হোসেন। তিনি জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, যেসব এলাকা দীর্ঘকাল ধরে মন্ত্রী হওয়া থেকে বঞ্চিত, সেসব জেলাকে এবার গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনী ইশতেহারে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা বাস্তবায়নের উপযোগী করে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে।