অনেক ‘পরীক্ষার’ ভোট আজ

স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ‘বিনা ভোটে’ বা ‘একতরফা’ জয়ী হওয়ার যে প্রবণতা চলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সেটা থেকে ব্যতিক্রম।

খবরের কাগজ হাতে পৌঁছার আগেই হয়তো ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে গেছেন অনেকে। আজ সকাল আটটা থেকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে উত্তাপের ভোট। স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে ‘বিনা ভোটে’ বা ‘একতরফা’ জয়ী হওয়ার যে প্রবণতা চলছে, নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচন সেটা থেকে ব্যতিক্রম। তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এই নির্বাচনের দিকে এখন সবার চোখ।

নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, প্রার্থীদের কেউ কেউ নানা শঙ্কার কথা বললেও পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত। তবে শেষ মুহূর্তে স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার তাঁর লোকদের গ্রেপ্তার, হয়রানি এবং বহিরাগত অনুপ্রবেশসহ সরকারি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগ ও ভোটকেন্দ্র থেকে সিসিটিভি খুলে নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন।

রাজধানী ঢাকার উপকণ্ঠের নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সেলিনা হায়াৎ আইভীর সঙ্গে লড়ছেন স্বতন্ত্র তৈমুর আলম খন্দকার। আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি এ নির্বাচনে নেই। তবু সরকারি দলের প্রার্থী আইভীর সঙ্গে ভোটে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন বিরোধী শিবিরের তৈমুর আলম। ফলে এ নির্বাচনে ভোটের ফল কী হয়, তা নিয়ে স্নায়ুচাপও আছে রাজনীতিতে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনে মোট ভোটার ৫ লাখ ১৭ হাজার। মেয়র পদে আছেন সাতজন প্রার্থী। এখানকার ২৭টি সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে ১৪৮ জন ও ৯টি সংরক্ষিত নারী আসনে ৩৪ জন প্রার্থী। মোট ১৮৯ জন মেয়র-কাউন্সিলর প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ। আজ সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত ১৯২টি ভোটকেন্দ্রে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোট গ্রহণ হবে।

এই নির্বাচনের শুরু থেকেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে সেলিনা হায়াৎ আইভী ও তৈমুর আলম খন্দকার। এর মধ্যে বিএনপির পদ থেকে তৈমুরের বাদ পড়া, ‘গডফাদার’ ইস্যুতে দলীয় সাংসদ শামীম ওসমানের সঙ্গে আইভীর পুরোনো বিরোধ জেগে ওঠা, গোপনে তৈমুরকে শামীম ওসমানের সহায়তার গুঞ্জন, পরে দলের উচ্চপর্যায়ের চাপে পড়ে নৌকার প্রার্থী আইভীর পক্ষে কাজ করতে শামীমের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা—এমন নানা ঘটনায় ভিন্ন মাত্রা পায় এই সিটি নির্বাচন।

নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের মূল্যায়ন হচ্ছে, মূলত দুই মেয়র প্রার্থীর ফলাফল নির্ভর করবে ভোটার উপস্থিতি কেমন হবে এবং কেন্দ্রে ভোটাররা কী ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, সেটার ওপর। উপস্থিতি ভালো হলে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস আছে। আইভী ব্যক্তি জনপ্রিয়তায় সাধারণ ভোটের পাশাপাশি দলীয় এবং সংখ্যালঘুদের ভোট পাবেন একচেটিয়া। ব্যক্তি তৈমুরেরও এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা আছে। বিএনপির একনিষ্ঠ সমর্থকদের পাশাপাশি শ্রমিক শ্রেণি এবং নিম্ন¤ও মধ্যবিত্তে তাঁর সমর্থন আছে। তৈমুরের প্রচারে বিএনপি দলীয়ভাবে উঠেপড়ে না লাগলেও বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজত—সব পক্ষ যদি ভেতরে-ভেতরে এক হয়ে ভোটকেন্দ্রে যায়, সেটা তৈমুরের জন্য সহায়ক হবে।

সরকারের মেয়াদের শেষ দিকে এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের বিদায়লগ্নে নারায়ণগঞ্জের এই নির্বাচন অনেকের জন্য পরীক্ষাও। বড় করে দেখলে এই সিটি নির্বাচনে সরকার কতটা নির্বিঘ্ন ও শান্তিপূর্ণ করে, সেটির একটি পরীক্ষা। অন্যদিকে বিদায়বেলা এই নির্বাচন কমিশন কী করে যায়, সেটারও পরীক্ষা। আবার আইভী জয়ী হলে নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমানদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব আরও খর্ব হবে। আর তৈমুর জয়ী হলে বিএনপির নেতৃত্বও প্রশ্নের সম্মুখীন হবে।

তৈমুরের প্রধান নির্বাচনী এজেন্টের বাসায় তল্লাশি

নির্বাচনের আগমুহূর্তে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় তৈমুর আলম খন্দকারের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট ও নারায়ণগঞ্জ মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এ টি এম কামালের মিশনপাড়ার বাসায় পুলিশ তল্লাশি চালায় বলে তৈমুর অভিযোগ করেছেন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে বিএনপির নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

সন্ধ্যা ছয়টায় তৈমুর আলম সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, তাঁর নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করতে প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট এ টি এম কামালকে গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে তাঁর বাসায় অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। কামালকে না পেয়ে তাঁর গাড়িচালক এবং একটি গাড়ির চাবি নিয়ে গেছে।

তৈমুর বলেন, ‘প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট হিসেবে কামাল কাগজপত্র দিয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে একটি গাড়ির অনুমোদন নিয়েছেন। গাড়িটি আমার বাসায়। কিন্তু গাড়ির চাবি পুলিশ নিয়ে গেছে। বলেছে সোমবারের আগে তারা চাবি দেবে না।’

এ বিষয়ে কথা বলার জন্য এ টি এম কামালকে পাওয়া যায়নি। তাঁর স্ত্রী সালমা সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ এসে জিজ্ঞেস করেছে কামাল কোথায়। এরপর তারা বাসায় ঢুকে তল্লাশি চালায়।

তবে পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, এ বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই।

এর আগে গতকাল দুপুরে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে তৈমুর আলম অভিযোগ করেন, গত শুক্রবার রাতে দলের কর্মী–সমর্থকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর আগে ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। পুলিশ তাঁদের মাদক ও হেফাজতের মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়েছে।

এই অভিযোগের বিষয়ে পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ কোনো ব্যক্তি, দল বা গোষ্ঠীর হয়ে কাজ করছে না, কাউকে হয়রানি করছে না। সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী গ্রেপ্তারি পরোয়ানা আছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

দুপুরের সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে তৈমুর বলেন, ‘আমি ভোটকেন্দ্র ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি না, পুলিশের আচরণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি, প্রশাসনের আচরণকে ঝুঁকিপূর্ণ ও নির্বাচন কমিশনের আচরণকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের মাঠে যা–ই হোক না কেন, মাঠে থাকব, গ্রেপ্তার হলে হব।’ তিনি ভোটকেন্দ্রে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে নির্বাচন কমিশন, ডিসি-এসপিকে নিরপেক্ষ থেকে সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানান।

বাসায় ছিলেন আইভী

তৈমুর আলম খন্দকার সকাল-সন্ধ্যা দুই দফায় সংবাদ সম্মেলন করে পুলিশি হয়রানির অভিযোগ করলেও তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সেলিনা হায়াৎ আইভী পাল্টা কোনো বক্তব্য দেননি। আইন অনুযায়ী প্রচারের সুযোগ না থাকায় বাসায়ই ছিলেন তিনি। তাঁর দেওভোগের বাসার প্রধান ফটক তালাবদ্ধ ছিল। যে কারণে গণমাধ্যমের কর্মীরা সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তাঁর সাক্ষাৎ পাননি। বিকেল চারটার দিকে তিনি বাসার প্রাঙ্গণে এলে সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন। এ সময় আইভী সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী, আজ তো আমার কিছু বলার কথা না।’

ভোটের প্রস্তুতি

গতকাল প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, সিটি এলাকার ২৭টি ওয়ার্ডের সব কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জামাদি পৌঁছেছে। পুলিশ, র‌্যাব, আনসার, বিজিবিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচ হাজারের অধিক সদস্য নির্বাচনে মোতায়েন থাকবেন। এ ছাড়া ভোটের নিরাপত্তায় ৩৯ জন ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশের ৭৫টি ও র‌্যাবের ৬৫টি টিম মাঠে থাকবে। ১৪ প্লাটুন বিজিবি মাঠে থাকবে। আরও ৬ প্লাটুন বিজিবি চাহিদা পাঠানো হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি মাঠে গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত রয়েছে বলে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ সাংবাদিকদের জানিয়েছেন।

গতকাল সকালে মাসদাইর পুলিশ লাইনস মাঠে নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও আনসার সদস্যদের নির্দেশনা দেন জেলা পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম। এ সময় রিটার্নিং কর্মকর্তা মাহফুজা আক্তারসহ পুলিশের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বেলা দুইটায় জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ তাঁর কার্যালয়ে নির্বাচন নিয়ে মতবিনিময় করেন। সেখানে পুলিশ সুপার ছাড়াও ৬২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আল আমিন, র‌্যাব-১১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তোফাজ্জল হোসেনসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

মতবিনিময় সভা শেষে তৈমুর আলমের লোকজনকে গ্রেপ্তার ও হয়রানির অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলে জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ্ বলেন, তৈমুর আলম এ ব্যাপারে লিখিত বা মৌখিক কোনো অভিযোগ দেননি। যারা নির্বাচন বানচাল করতে পারে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে, দাগি আসামি, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ এটা নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে করছে।

ভোটকেন্দ্র থেকে সিসি ক্যামেরা খুলে ফেলা অভিযোগ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমাদের সব কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা নেই। কিছু কেন্দ্রে সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেগুলো খুলে ফেলার কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।’

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক ধীমান সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ নির্বাচনে ত্রিমুখী একটা লড়াইয়ের ব্যাপার আছে। তৈমুর না কেন্দ্রীয় বিএনপির, না স্থানীয় বিএনপির। তিনি এ ধরনের ছায়া প্রার্থী। এটা তাঁর জন্য পজিটিভ না। অন্যদিকে ব্যক্তি আইভীর যে ভাবমূর্তি, তা তাঁর প্রতীকের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে দলীয় বিভক্তি স্পষ্ট। আবার তাঁর নির্বাচনে কেন্দ্রীয় নেতাদের কারও কারও বক্তব্য অনেককে আহত করেছে।’