আ.লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে সাদামাটা আয়োজন, প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসূচি

করোনার কারণে তিন মাস ধরেই মানুষ অনেকটা ঘরবন্দী। এ সময় রাজনীতিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একে অন্যের খোঁজ নেওয়া, কিছু ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যুক্ত হওয়া—এতেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এরই মধ্যে বছর ঘুরে দেশের পুরোনো ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী চলে এল। এবার আর খোলা মাঠে, অনেক মানুষের সমাগমে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচি হচ্ছে না। সবই চার দেয়ালে, ডিজিটাল মাধ্যমে সীমাবদ্ধ থাকছে। বাইরের কর্মসূচির বলতে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতি ও গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ায় তাঁর মাজারে স্বল্পসংখ্যক মানুষের উপস্থিতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন রয়েছে।

আগামীকাল ২৩ জুন। আওয়ামী লীগের ৭১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। ১৯৪৯ সালের এই দিনে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী কে এম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ নামে এই দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। পরে আওয়ামী লীগ নাম নিয়ে দলটি আর বিকশিত হয়। দেশের স্বাধীনতা এনে দেওয়া দলটির ইতিহাস তাই বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে।

কালক্রমে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—দুটি নাম একে অপরের পরিপূরক হয়ে ওঠে। এবার বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করছে দেশ। সে হিসাবে এবারের আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীও জাঁকজমকপূর্ণই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সবকিছু পাল্টে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এ বছর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সাজসজ্জা ও অন্যান্য কর্মসূচির খরচ বাঁচিয়ে তা দুস্থদের মাঝে ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

প্রতিবছরই ২২ জুন দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে মহানগর ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের উদ্যোগে কেক কেটে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন শুরু হতো। এরপর সূর্যোদয়ের ক্ষণেÿসব দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করা হতো। আর সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে দলীয় সভাপতিসহ অন্যরা ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতেন। এ ছাড়া আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা হতো। কিন্তু এবার করোনাভাইরাসের মহামারির কারণে দলের সব কর্মসূচিই স্থগিত করা হয়েছে।

প্রতিষ্ঠার শুরুতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শামসুল হকের মতো প্রথিতযশা নেতারা। এই দল ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধসহ প্রতিটি গণতান্ত্রিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে জনগণের পাশে থেকে গণমানুষের সংগঠনে পরিণত হয়।

’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন ও ’৬৯-এর গণ–অভ্যুত্থান সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এ দেশের মানুষকে সংগঠিত করে আওয়ামী লীগ। এভাবে ২৪ বছরের সংগ্রাম পরিণতি পায় ১৯৭১ সালে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের লাল-সবুজের পতাকা ও বাংলাদেশের মানচিত্র অর্জিত হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যা করে কিছু বিপদগামী সেনাসদস্য। এরপর সাময়িকভাবে কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে এসে দলের হাল ধরেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তারপর থেকেই তিনি এই দলের সভাপতি।

দীর্ঘ ২১ বছর লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০১ সালে ক্ষমতার বাইরে চলে যায় দলটি। এক-এগারোর ঝঞ্ঝা মোকাবিলা করে ২০০৯ সালে পুনরায় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ ও এর মিত্ররা। সেই থেকে টানা ক্ষমতায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। পরবর্তী সময়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুযারির এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ।

টানা ১২ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগ আমলেই আদালতের রায় ধরে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করা হয়। ২০১৪ সালে নির্বাচনে বিএনপিসহ অধিকাংশ দল নির্বাচন বর্জন করে। অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সাংসদ আওয়ামী লীগের হন। তবে ২০১৮ সালে সব দল অংশ নিলেও প্রচারনায় সবার জন্য সমান সুযোগ ছিল না বলে অভিযোগ ওঠে। এমনকি ভোটের আগের রাতে সিল মারার অভিযোগও ওঠে, যা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে নেতিবাচক অধ্যায় হিসেবেই বিবেচনা করেন কেউ কেউ।

এই এক যুগে আওয়ামী লীগ সরকার বেশ শক্তিশালী হয়ে ওঠে। দলীয় কর্মকাণ্ড কমতে থাকে। দল সরকারে বিলীন হয়ে গেছে কি না, এমন আলোচনাও শুরু হয়। গত বছর সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনে অধিকাংশ মন্ত্রীকে দলীয় পদ থেকে বাদ দেওয়া হয়।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, বাঙালি জাতির প্রতিটি মহৎ, শুভ ও কল্যাণকর অর্জনে আওয়ামী লীগের ভূমিকা রয়েছে। ভবিষ্যতেও জনগণকে সঙ্গে নিয়ে জাতির পিতার স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী-সমৃদ্ধ, উন্নত ও আধুনিক সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করবে আওয়ামী লীগ।

কর্মসূচি
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সীমিত পরিসরে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বাঙালি জাতির স্বাধীনতা, মুক্তি, গণতন্ত্র ও প্রগতি প্রতিষ্ঠায় আত্মদানকারী সব শহীদ ও সাম্প্রতিক সময়ে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া দলের নেতাদের জন্য দোয়া চাওয়া হয়।

সাম্প্রতিক মারা যাওয়া নেতারা হলেন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মকবুল হোসেন, কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বদর উদ্দীন আহমদ কামরান, ধর্মবিষয়ক সম্পাদক ও ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রমুখ।

এবারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সূর্যোদয়ের ক্ষণে কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও দেশব্যাপী আওয়ামী লীগ দলীয় কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন। এরপর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন। তবে এবারের এই কর্মসূচি উম্মুক্ত নয়। সীমিতসংখ্যক নেতাদেরই সুযোগ দেওয়া হবে। বিকেলে বঙ্গবন্ধুসহ দলের প্রয়াত নেতাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত হয়।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের একটি প্রতিনিধিদল শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করবেন। এতে সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন উপস্থিত থাকবেন।

গতকাল রাত সাড়ে আটটায় আওয়ামী লীগের তরুণ নেতাদের নিয়ে অনলাইন জুমের মাধ্যমে ‘তারুণ্যের প্রত্যাশায় আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। আজ জ্যেষ্ঠ নেতাদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হবে ‘গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ’ শীর্ষক আলোচনা।