আন্দোলন নিয়ে তাড়াহুড়া করবে না বিএনপি

বৈঠকে আমন্ত্রিতদের ৬৮ জন অনুপস্থিত ছিলেন। তাঁদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হবে।

বিএনপি

দীর্ঘদিন পর দুই দফায় ছয় দিনের বৈঠক ভালো সাড়া ফেলেছে বলে মনে করছেন বিএনপির কেন্দ্রীয় ও মাঠপর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা।
তাঁরা বলছেন, এই বৈঠকের আয়োজন কেন, আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতারা কী চিন্তা করছেন; সে ব্যাপারে মাঠপর্যায়ে একটা বার্তা গেছে।

তবে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধারাবাহিক বৈঠকগুলো থেকে মতামত যা-ই আসুক না কেন, তাড়াহুড়া করে বা এখনই কোনো আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা নেই নীতিনির্ধারকদের। কারণ, নির্বাচন এখনো সোয়া দুই বছর দূরে। আন্দোলনের জন্য দল সাংগঠনিকভাবে এখনো প্রস্তুত নয়। অন্যদিকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠনের যে প্রক্রিয়া চলছে, তা শেষ হতে আরও এক বছর লাগতে পারে। আন্দোলনের মূল কেন্দ্র ঢাকায় মাত্র আহ্বায়ক কমিটি হয়েছে। এ ছাড়া আন্দোলনে সফল না হলে তার পরিণতি কী হবে, দলের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, এ বিষয়গুলোও বিবেচনায় নিতে হচ্ছে শীর্ষ নেতৃত্বকে।

নেতারা চেয়ারপারসনের মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। নীতিনির্ধারণী পর্ষদে পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, মহাসচিব, বিএনপি

দলীয় সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে একটি রাজনৈতিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করতে যাচ্ছে বিএনপি। এ লক্ষ্যে একটি রূপরেখার খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সেটি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের মতামত নিতে ছয় দিনের ধারাবাহিক বৈঠকের আয়োজন করা হয়। এর উদ্দেশ্য, ভবিষ্যতে আন্দোলন কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং দলীয় ঐক্য ও সংহতি দৃঢ় করা। সে বিবেচনায় এ বৈঠকের অর্জন ইতিবাচক বলে মনে করছেন দলের নীতিনির্ধারকেরা।

এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা যে কর্মসূচিই গ্রহণ করি না কেন, সে জন্য মতামত নিলাম। অনেক সময় কথা ওঠে, কর্মসূচি চাপিয়ে দেওয়া হয়; এর মধ্য দিয়ে সেটারও নিরসন হলো।’

ছয় দিনের বৈঠক সম্পর্কে গয়েশ্বর রায়ের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, নেতাদের যে মতামত এসেছে, তাতে কিছু কৌশলগত দিক ছাড়া মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সবার মত হচ্ছে, দলীয় প্রধান খালেদা জিয়ার মুক্তি আর গণতন্ত্রের মুক্তি একই সূত্রে গাঁথা। আর নেত্রীর মুক্তিই হচ্ছে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পূর্বশর্ত।

বিএনপির কেন্দ্রীয় দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে দুই দফায় তিন দিন করে ছয় দিনের এ বৈঠকে প্রায় ৩৫ ঘণ্টা আলোচনা হয়। রুদ্ধদ্বার এ বৈঠকে ২৮১ জন নেতা বক্তব্য দেন। মোটাদাগে নেতারা আগামী সংসদ নির্বাচন, দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি, দল এবং জোটের ব্যর্থতা, দুর্বলতাসহ নানা বিষয়ে নিজেদের মতামত জানান।

বৈঠকে উপস্থিত সূত্রগুলো জানায়, ধারাবাহিক বৈঠকগুলোতে একটি বিষয়ে সবাই একমত যে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীন কোনো নির্বাচনে অংশ নেওয়া যাবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক আন্দোলনের অন্য কোনো বিকল্প নেই। যদিও আগামী সংসদ নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার বিষয়ে দলের নীতিনির্ধারকেরা কোনো সিদ্ধান্ত নেননি। আবার জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিও কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা এখনো নির্ধারিত হয়নি।

অবশ্য ছয় দিনের এ বৈঠককে ‘খুবই ইতিবাচক’ বলে মনে করেন বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম (মঞ্জু)। তিনি গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত তিন বছরে এই প্রথম বিএনপি মাঠপর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বসেছে এবং ভবিষ্যতে দলের রাজনীতি কী হবে, সে বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মনে করি, ভুলত্রুটি শুধরে বিএনপি একটি কার্যকরী ও গঠনমূলক ভাবনা নিয়ে হাজির হবে।’

প্রথম দফায় ১৪ থেকে ১৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত, দ্বিতীয় দফায় ২১ থেকে ২৩ সেপ্টেম্বর ধারাবাহিকভাবে ছয় দিন বৈঠক হয়। এসব বৈঠকে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যসহ দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ৫৮৪ জন সদস্যের মধ্যে ৫২৫ জনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর মধ্যে ৪৫৭ জন বৈঠকে উপস্থিত হন। বক্তব্য দেন ২৮১ জন। বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সভাপতিত্ব করেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

দলীয় সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন পর ডাকা বিএনপির নির্বাহী কমিটির এসব বৈঠকে যাঁরা আমন্ত্রণ পেয়েও উপস্থিত হননি, তাঁদের দল থেকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হচ্ছে। আমন্ত্রিত নেতাদের মধ্যে ৬৮ জন অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, এই বৈঠক দলে বেশ সাড়া ফেলেছে এবং নেতা-কর্মীদের মধ্যে একটি ইতিবাচক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তিনি বলেন, বৈঠকে নেতারা মূলত বিএনপির চেয়ারপারসনের মুক্তি, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিষয়ে মতামত ও পরামর্শ দিয়েছেন। এখন নীতিনির্ধারণী পর্ষদে বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দেওয়া হবে।

বিএনপি সূত্র জানায়, ছয় দিনের বৈঠকের মতামতগুলো পর্যালোচনা করে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে। তার আগে গণতন্ত্র, নির্বাচন, ভোটাধিকার, সুশাসন ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে পেশাজীবী এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা বসবেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ নজরুল মনে করেন, বিএনপি এখনো বৃহত্তর ঐক্য গড়তে পারেনি। এখন তারা যদি সব বিরোধী দলকে বোঝাতে পারে যে ক্ষমতায় গেলে তারা সুশাসন দিতে সক্ষম, তাহলে একটি বৃহত্তর ঐক্য গড়ে আন্দোলনে সাফল্য পেতে পারে। তবে সমস্যা হচ্ছে, বিএনপির নেত্রী বিশেষ ব্যবস্থায় নিজ বাসভবনে আছেন। আওয়ামী লীগ এটাকে চাল হিসেবে ব্যবহার করবে। এ ছাড়া বর্তমান সরকার রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে যে একটি শক্তি অর্জন করেছে, তাকে তারা সর্বাত্মকভাবে দমন করার চেষ্টা করবে। এটি বিএনপির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।