আ.লীগ-বিএনপির ভোটে অস্বাভাবিক ব্যবধান

আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দলীয় লোগো

রাজনীতির মাঠে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। কিন্তু সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনের মতো তৃণমূলের নির্বাচনের ফলাফলেও দেখা যাচ্ছে পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র। একচেটিয়া ভোট পড়ছে নৌকায়। বিপরীতে ধানের শীষের প্রার্থীদের অনেকে জামানত হারাচ্ছেন।

অবশ্য ভোটের এই ফলাফল বাস্তবতার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের কেউ কেউ। বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা মেয়র পদে নিজের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দিতে পারেননি। আবার বিএনপির প্রার্থীদের বেশির ভাগ নির্বাচনী প্রচারে যতটা তৎপর ছিলেন, ভোটের দিন কেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেওয়া, এজেন্ট রাখা এবং কেন্দ্রে ভোটার আনার ক্ষেত্রে ততটা সক্রিয় দেখা যায়নি।

গত শনিবার দ্বিতীয় ধাপে দেশের ৬০টি পৌরসভায় ভোট গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে চারটি পৌরসভায় প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় মেয়র পদে ভোট হয়নি। বাকি ৫৬টি পৌরসভার মধ্যে ৩০টিতে জামানত হারিয়েছেন বিএনপির প্রার্থীরা। বিপরীতে বিপুল বিজয়ের মধ্যেও একটি পৌরসভায় নৌকার প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোট প্রদত্ত ভোটের ৬০ শতাংশ পড়েছে নৌকায়। এর মধ্যে ১৪টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ৮০ থেকে ৯৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আর ধানের শীষে পড়েছে ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। মাত্র ৮টি পৌরসভায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রার্থীর মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।

আচরণবিধি অমান্য করে শোভাযাত্রা করে মনোনয়ন জমা দিতে যাচ্ছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ও বর্তমান পৌর মেয়র আলমগীর সরকার
ফাইল ছবি

দ্বিতীয় ধাপে ভোটের হার প্রথম ধাপের চেয়ে সামান্য কমেছে। এই ধাপে ভোট পড়েছে ৬১ দশমিক ৯২ শতাংশ। প্রথম ধাপে ভোটের হার ছিল ৬৫ শতাংশ।
এর আগে গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের নির্বাচনেও একই চিত্র দেখা গিয়েছিল। প্রথম ধাপে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৬৪ শতাংশ ভোট। আর বিএনপি পেয়েছিল সাড়ে ১৩ শতাংশ। ওই নির্বাচনে ১২টি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছিলেন।

জামানত গেছে বিএনপির প্রার্থীদের

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জামানত হিসেবে জমা দিতে হয়। পৌরসভায় ভোটারসংখ্যা অনুপাতে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা জামানত হিসেবে মেয়র প্রার্থীদের জমা দিতে হয়। মোট প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত হয়। ৩০টি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত ভোট পাননি।

নওগাঁ পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জেলা বিএনপি
ফাইল ছবি

ইসি সচিবালয় থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, যেসব পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন, সেগুলো হলো দিনাজপুরের বিরামপুর ও বীরগঞ্জ; কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী; গাইবান্ধা সদর ও সুন্দরগঞ্জ; বগুড়ার সারিয়াকান্দি; রাজশাহীর ভবানীগঞ্জ ও আড়ানী; নাটোরের গোপালপুর ও গুরুদাসপুর; সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া; নরসিংদীর বেলকুচি ও রায়গঞ্জ; পাবনার ঈশ্বরদী; মেহেরপুরের গাংনী; কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা, মিরপুর ও শৈলকুপা; বাগেরহাটের মোংলা পোর্ট; মাগুরা সদর; নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ; ঢাকার সাভার; নরসিংদীর মনোহরদী; শরীয়তপুর সদর; সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর; মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ও কুলাউড়া; ফেনীর দাগনভূঞা; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও বান্দরবানের লামা।

নৌকার প্রার্থীরও জামানত গেছে

চারদিকে নৌকার জয়জয়কার হলেও হবিগঞ্জের মাধবপুরে জামানত হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী। ওই পৌরসভায় মোট ভোট পড়েছে ১৩ হাজার ১০৫টি। জামানত ফিরে পেতে ভোট দরকার ১ হাজার ৬৩৮টি। কিন্তু এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শ্রীধাম দাশ গুপ্ত পেয়েছেন মাত্র ৬০৮ ভোট। এই পৌরসভায় চার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর মধ্যে তিনি চতুর্থ হয়েছেন। জয়ী হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়েছেন দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থী।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বগুড়ার শেরপুর ও সান্তাহার; নওগাঁর নজিপুর; রাজশাহীর কাকনহাঁট; পাবনার ফরিদপুর; ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া; কিশোরগঞ্জ সদর এবং হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে।

প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বগুড়ার শেরপুর ও সান্তাহার; নওগাঁর নজিপুর; রাজশাহীর কাকনহাঁট; পাবনার ফরিদপুর; ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া; কিশোরগঞ্জ সদর এবং হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে। এর মধ্যে বগুড়ার শেরপুরে অবশ্য জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী (বিএনপির বিদ্রোহী)। সান্তাহার ও নবীগঞ্জে বিএনপির প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এর বাইরে মাধবপুর এবং দিনাজপুর সদরে বিএনপি জয়ী হয়েছে। ওই দুই পৌরসভায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভোটের ব্যবধান অনেক। কিশোরগঞ্জে একটি কেন্দ্রে ভোটের ফল ঘোষণা করা হয়নি। বাকিগুলোতে জয় পেয়েছে আওয়ামী লীগ।

গত জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট প্রদত্ত ভোটের ৭৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল। আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্ট পেয়েছিল ১৫ শতাংশের মতো। এর আগের বিভিন্ন জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পেয়েছিল ৪৯ শতাংশ ভোট। বিএনপি পেয়েছিল ৩৩ দশমিক ২ শতাংশ।

বাস্তবতার সঙ্গে ঘোষিত ফলাফলের মিল দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের এত ব্যবধান—এটি সংগতিপূর্ণ মনে হয় না।
বদিউল আলম মজুমদার, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক

অতীত এবং বর্তমান বাস্তবতার সঙ্গে এবারের পৌর নির্বাচনের ভোটের ফলাফল সংগতিপূর্ণ নয় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাস্তবতার সঙ্গে ঘোষিত ফলাফলের মিল দেখা যাচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে ভোটের এত ব্যবধান—এটি সংগতিপূর্ণ মনে হয় না। বিএনপির বেশির ভাগ প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন, এটাও বিশ্বাসযোগ্য নয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনেরই বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তারা দায়িত্বে থাকার নৈতিক অধিকার হারিয়েছে।