আ.লীগ–বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের সহিংসতায় এক ইউনিয়নেই ৫ খুন

প্রতীকী ছবি

ঝিনাইদহের শৈলকুপার সারুটিয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান মামুন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এ ইউপির নির্বাচনে তাঁর কাছে হেরেছেন তাঁরই দলের বিদ্রোহী চেয়ারম্যান প্রার্থী জুলফিকার কায়সার ওরফে টিপু। তিনি এ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি (সদ্য বহিষ্কৃত)। এই দুই নেতার কর্মী-সমর্থকেরা নির্বাচনের আগে থেকেই লিপ্ত মারামারি-কাটাকাটিতে। এর বলি হয়েছেন পাঁচজন। তা-ও মাত্র ২৩ দিনে। সর্বশেষ ব্যক্তি খুন হয়েছেন গত শুক্রবার রাতে।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলছেন, ওই পাঁচজনের কেউ সক্রিয়ভাবে রাজনীতি করেন না।

শৈলকুপা উপজেলার সারুটিয়া ইউনিয়নে নির্বাচনী সহিংসতায় শুক্রবার রাতে খুন হন মেহেদী হাসান ওরফে স্বপন (২৫)। তাঁকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করে প্রতিপক্ষ। মেহেদী সারুটিয়া গ্রামের দবির উদ্দিন শেখের পুত্র। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে আহত হওয়ার পর হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান মেহেদী।

মেহেদীর মা ইয়াসমিন বেগম বলেন, তাঁর ছেলে খারাপ কাজের মধ্যে থাকে না। ভোটের সময় একজনের পক্ষে ভোট করেছে। এটাই তার অপরাধ। বর্তমান চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তিনি এই হত্যার বিচার চান।

পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মেহেদীকে নিয়ে ৫ জানুয়ারির ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ২৩ দিনে সারুটিয়া ইউনিয়নে যে পাঁচজন খুন হয়েছেন, তাঁদের তিনজন নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে থাকা অবস্থায় প্রতিপক্ষের হামলার শিকার হন। অন্য দুজনকে পৃথক স্থানে কুপিয়ে ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়।

এদিকে শৈলকুপার বগুড়া ইউনিয়নে ৮ জানুয়ারি খুন হয়েছেন কল্লোল হোসেন নামের আরেকজন। তিনিও নির্বাচনী সহিংসতার শিকার। অর্থাৎ এক উপজেলাতেই ইউপি নির্বাচনের আগে-পরে সহিংসতায় ছয়জন মারা গেলেন।

সারুটিয়া ইউনিয়নে নিহত মেহেদীর বোনজামাই মিলন হোসেনের ভাষ্যমতে, শুক্রবার রাত সাড়ে নয়টার দিকে প্রতিপক্ষের লোকজন মেহেদীকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান। মেহেদী ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকার কায়সারের সমর্থক। বৃহস্পতিবার জুলফিকারের প্রতিপক্ষ ও বিজয়ী চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসানের সমাজে (সমর্থক দল) যোগ দেন মেহেদী। সমর্থকদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শুক্রবার রাতে বাড়ির বাইরে যান মেহেদী। এরপর তালতলা ব্রিজ নামক স্থানে চেয়ারম্যানের সমর্থকেরাই তাঁকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে গুরুতর জখম করেন। স্বজনেরা তাঁকে উদ্ধার করে শৈলকুপা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান। চিকিৎসক তাঁকে দ্রুত উন্নত চিকিৎসার জন্য ফরিদপুর মেডিকেলে নেওয়ার পরামর্শ দেন। পরে ফরিদপুরে নেওয়ার পথে রাত দুইটার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।

মেহেদীর মা ইয়াসমিন বেগম বলেন, তাঁর ছেলে খারাপ কাজের মধ্যে থাকে না। ভোটের সময় একজনের পক্ষে ভোট করেছে। এটাই তার অপরাধ। বর্তমান চেয়ারম্যানের লোকজন তাকে কুপিয়ে হত্যা করেছে। তিনি এই হত্যার বিচার চান।

অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান মাহমুদুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, মেহেদী আগে যেটাই করুক, বৃহস্পতিবার থেকে সে তাঁর সমাজের লোকজনের সঙ্গে মিশে ছিল। যারাই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের উপযুক্ত বিচার হবে এটা তিনিও চান। অপরাধীদের যেন কোনো ছাড় দেওয়া না হয়।

স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ-সমর্থিত চেয়ারম্যান মাহমুদুল ও পরাজিত বিদ্রোহী প্রার্থী জুলফিকারের কর্মী-সমর্থকেরা নির্বাচনের আগে থেকে সহিংসতা আর হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছেন। তাঁরা তফসিল ঘোষণার আগে থেকে মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে লবিং-গ্রুপিং করছিলেন। এরপর দলীয় মনোনয়ন ঘোষণার পর মাহমুদুল আবার নৌকা প্রতীক পান। আর জুলফিকার বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন জমা দেন। আনারস প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি।

সারুটিয়া গ্রামের প্রত্যক্ষদর্শী এক বাসিন্দা বলেন, মাহমুদুল নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রথম যেদিন কাতলাগাড়ি বাজারে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা নিয়ে আসেন, সেদিনই প্রথম মারামারির ঘটনা ঘটে। এরপর ৩১ ডিসেম্বর কাতলাগাড়ি বাজারে নৌকার নির্বাচনী কার্যালয়ে হামলা চালায় প্রতিপক্ষ। সেখানে বসে থাকা অবস্থায় পাঁচজনকে কুপিয়ে আহত করা হয়। শৈলকুপা হাসপাতালে নেওয়ার পর মারা যান হারান আলী নামের একজন। তিনি কাতলাগাড়ি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ছিলেন। পরদিন ভাটবাড়িয়া গ্রামের জসিম উদ্দিনকে বাড়ির পাশে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। জসিমও ছিলেন নৌকার সমর্থক। ৫ জানুয়ারি ভোটের দিন ৩১ ডিসেম্বরের ঘটনায় আহত অখিল সরকার কুষ্টিয়া হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনিও আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা ছিলেন। ৭ জানুয়ারি রাজশাহীতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান আবদুর রহিম। তিনিও ওই ঘটনায় আহত হয়েছিলেন। সর্বশেষ মারা গেলেন মেহেদী।

নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা দাবি করেন, যাঁদের হত্যা করা হয়েছে, তাঁরা কেউ সক্রিয় রাজনীতি করতেন না। নির্বাচনের সময় ভোটের উৎসব দেখতে নির্বাচনী ক্যাম্পে যান। সেখানে বসে থাকা অবস্থায় বেশির ভাগ হামলার ঘটনা ঘটে।

নিহত আবদুর রহিমের ছেলে অহিদুল ইসলাম বলেন, তাঁর বাবা ছিলেন চেয়ারম্যান মাহমুদুলের সমর্থক। তিনি কোনো রাজনীতি না করলেও ভোটের সময় নৌকার অফিসে গিয়েছিলেন। প্রতিপক্ষ জুলফিকারের সমর্থকেরা হামলা চালিয়ে তাঁকে হত্যা করেছেন। তাঁরা অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে বাঁচাতে পারেননি। তিনি এ হত্যার বিচার দাবি করেন।

নিহত হারান আলীর স্ত্রী সুফিয়া বেগম বলেন, তাঁর স্বামী খুবই দরিদ্র। তাঁর এক ছেলে প্রতিবন্ধী। এখন তিনি কীভাবে বেঁচে থাকবেন, ভেবে পাচ্ছেন না।

মেহেদী খুনের বিষয়ে শৈলকুপা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম বলেন, নির্বাচনী সহিংসতায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে তাঁদের ধারণা। হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের আটকের চেষ্টা চলছে। সর্বশেষ খুনের ঘটনায় এখনো মামলা হয়নি।